জয়নাল আবেদীন : বাংলা ১২৫৪ সাল। মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়ার ভূস্বামী পদ্মলোচন রায় পুখুরিয়া পরগনার জমিদার ভৈরবচন্দের নিকট থেকে দুই আনার তালুক কেনেন। পদ্মলোচন স্বর্গীয় হলে পুত্র কালীচন্দ্র রায় ১২৬১ সালে ওই পরগনার নীলামে উঠা বাকি চার আনা তালুক ও ক্রয় করেন। ততদিনে আমবাডিয়া জমিদারের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। কালীচন্দ্র স্বর্গীয় হলে পুত্র হেমচন্দ্র রায় মুক্তাগাছার মহারাজা সূর্যকান্ত রায়ের সাথে টেক্কা দিয়ে জয়েনশাহী পরগনার নীলাম হওয়া তালুকের পাঁচ আনা আড়াই গন্ডা ( ৮৫ হাজার একর) ক্রয় করেন। এভাবে উত্তর টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় চার লক্ষ একরে হেমচন্দ্র রায়ের জমিদারি বিস্তৃত হয়। তিনি রায় থেকে হন চৌধুরী। নিকটবর্তী ধনবাড়ির মুসলিম জমিদার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর সাথে রাজকাচারি, প্রজাস্বত্ব এবং মৌজার সীমানা নিয়ে সহসাই বিরোধ দেখা হয়। হেমচন্দ্র চৌধুরী জাতে ছিলেন কুলীণ ব্রাম্মন। ধর্মকর্মে নিষ্ঠাবান। নিজ সম্প্রদায়ের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ। স্বভাবগতভাবে নাক উঁচিয়ে চলা মানুষ।
হেমনগর রাজবাড়ির সামনে দাড়িয়ে ওপার বাংলার শিল্পী পৌলমী গাঙ্গুলী
অন্যদিকে নবাবজাদা নওয়াব আলী চৌধুরী ও ছিলেন মুসলিম আাভিজাত্যের প্রতীক। ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন। ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর সাথে ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ। সুতরাং কুলীণ ব্রাম্মণ আর অভিজাত মুসলিম জমিদারের মধ্যে ক্রমান্বয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এ প্রবন্ধকার নিজস্ব গবেষণায় সমসাময়িক বেশ কয়েকটি ঘটনার বিশ্লেষণে সম্পর্কের অবনতির একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন। যার সবকটিই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিজাত, ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং ব্রিটিশ বেনিয়াদের কূটচালজনিত। এসব চুলচেরা বিশ্লেষণ বর্তমান নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। পরে ওইসব নিয়ে অন্যত্র আলোচনার ইচ্ছে রয়েছে।
যাই হোক, হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৮৮০ সালে মধুপুর উপজেলার আমবাডিয়া রাজবাড়ি ত্যাগ করে গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের সুবর্ণখালি গ্রামে নতুন রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। সেখান থেকেই জমিদারী চালানো শুরু করেন। তখন বাংলার রাজধানী ছিল কোলকাতা। আর সুবর্নখালি ছিল যমুনা তীরের বিখ্যাত নদী বন্দর। কোলকাতার সাথে নদীপথে সহজেই যোগাযোগ করা যেতো। আসাম ও কোলকাতার স্টীমার ভিড়তো তখন সুবর্ণখালিতে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৯০৫ সালে হেমচন্দ্র চৌধুরীসহ কয়েকজন হিন্দু জমিদারের প্রচেষ্টায় ১৯০৫ সালে ময়মনসিংহ থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন সম্প্রসারণ করা হয়। এখান থেকে স্টীমারে যমুনা পাড়ি দিয়ে সিরাজগঞ্জের মাধ্যমে কোলকাতা পর্যন্ত রেলপথ কানেক্ট করা হয়। ইতিপূর্বে ময়মনসিংহ-ঢাকা রেলপথ চালু থাকায় ঢাকা টু কোলকাতা যাতায়াত সহজতর হয়। সরিষাবাড়ি উপজেলার জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে হেমচন্দ্র চৌধুরীর সুবর্ণখালির দূরত্ব ছিল মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। সড়কের এ অংশটুকু হেরিংবন্ড করে জগন্নাথগঞ্জঘাটের রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত টমটম অথবা পালকিতে যাওয়াআসার সুবন্দোবস্ত করেন হেমচন্দ্র চৌধুরী। এ হেরিংবন্ড সড়কটিই গোপালপুর উপজেলার ইতিহাসে প্রথম পাঁকা সড়ক।
এদিকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে যমুনা নদী বাঁক পরিবর্তন শুরু করলে ভাঙ্গনে সুবর্ণখালি বন্দর বিলুপ্ত হয়। হেমচন্দ্র চৌধুরীর রাজবাড়িও নদীগর্ভে নিমজ্জিত হয়। সুবর্ণখালি ঐতিহ্য হারিয়ে বর্তমানে সোনামুই নাম ধারণ করে কোনোভাবে টিকে রয়েছে। হেমচন্দ্র চৌধুরী সুবর্ণখালি থেকে তিন কিলো পূর্ব-দক্ষিনে শিমলাপাড়া মৌজায় ১৮৯০ সালে নতুন একটি দ্বিতল রাজপ্রাসাদ নির্মান করেন। নাম পরীদালান। ভবনের মূল অংশে উড়ন্ত দুই পরীর ভাস্কর্য ছিল। সামনের অংশে লতাপাতা আর কাব্যিক ডেকোরেশন ছিল চোখে পড়ার মত। দামি কড়ি আর পাথরে মোড়াই ছিল রাজবাড়ির মূল অংশ। উঁচু আর পুরু দেয়ালে ঘেরা রাজবাড়ির উঠান চত্বর শেষে ছিল প্রশস্ত দীঘি। এর শানবান্দা ঘাট সাদা পাথরে মোড়াই করা। রাজবাড়ির সামনে ও পাঁকা সিড়ির বিশাল দীঘি। রাজবাড়ির আশপাশে আত্মীয় স্বজনের জন্য একাধিক দীঘি ও পাঁকাবাড়িঘর নির্মাণ করে দেন তিনি। রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে দক্ষিন প্রান্তে গড়ে উঠে বিশাল বাজার। কালক্রমে হেমচন্দ্রের নামানুসারে নাম হয় হেমনগর।
ময়মনসিংহ জেলার ইতিহাস থেকে জানা যায়, হেমনগর বাজারে ছিল বিখ্যাত গণিকালয়। খদ্দেররা সেখানে শুধু কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থের জন্যই আসতেন না। সেখানে অনেক গুণী বাঈজির আসর বসতো। শিবানী নামক এক রুপবতী বাঈজীর নাচগান উপভোগ করতে সভ্রান্ত হিন্দু ও মুসলমানরা ধরনা দিতেন। হেমনগর প্রমোদালয় নিয়ে অনেক রসালো কাহিনী রয়েছে। এমন একটি হলো, ওই প্রমোদালয় থেকে ময়ূরী নামক রুপবতী বাঈজীকে ভালোবেসে ভাগিয়ে নিয়ে যান ধনবাড়ি উপজেলার বলিভদ্র ইউনিয়নের পানকাতা গ্রামের লাঠিয়াল আজিজুল হক। আজিুজুল ছিলেন ধনবাড়ি জমিদারের নায়েব কাচারির লাঠিয়াল। হেমনগর জমিদারের নায়েব জগন্নাথ মিত্র ক‘জন লাঠিয়াল নিয়ে বাঈজী উদ্ধারে পানকাতা গ্রামে হানা দেন। ইতিমধ্যে বাঈজী ময়ূরী ধর্মান্তরিত হয়ে আজিজুলকে নিকাহ করায় গ্রামবাসিরা হিন্দু নায়েবকে বাধা দেন। সংঘর্ষে উভয় পক্ষে কয়েকজন আহত হন। ময়ূরীকে রেখেই প্রস্থান করেন জগন্নাথ মিত্র। তবে জমিদারের নায়েব বলে কথা! পানকাতা ও এর আশপাশের দশ গ্রামের মানুষকে রাজা হেমচন্দ্রের তালুকে অবস্থিত ঝাওয়াইল, নন্দনপুর ও নলিন হাটে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রতিদ্বন্ধি ধনবাড়ির জমিদার সুযোগ বুঝে ওইসব প্রজার পাশে দাড়ায়। হাটের খাজনা মওকুফ করে ভেঙ্গুলা হাটকে চাঙ্গা করা হয়। ভেঙ্গুলার আশপাশের ক‘জন হিন্দু ও মুসলিম তালুকদার ও চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় ভেঙ্গুলা ও হাদিরা বাজারে গড়ে উঠে গনিকালয়। হেমনগর জমিদারের নায়েবগোমস্তরাও বসে ছিলনা। অসভ্য ও ফুর্তিবাজ লোক দিয়ে গোপালপুর থানার নন্দনপুর, কুটির বয়রা ও নলিন বাজারে পাল্টা গনিকালয় বসায়। ডাক্তার মফিজ আহমদের‘ ময়মনসিংহ এলাকার সংস্কৃতির রুপান্তর’ গ্রন্থে পুকুরিয়া, জয়েনশাহী, আলেপসিং, সন্তোষ এবং কাগমারি পরগনায় ৩৫টি গনিকালয়ের তথ্য দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ অবস্থাপন্ন মুসলমানরা তিন থেকে চারটি করে বিয়ে করতো। আর হিন্দু জোতদার, তালুকদার ও চেীধুরীরা বাইজীমহলে গমনকে সিংহ পুরুষের কাজ বলে ভাবতো। এজন্য হিন্দু ও মুসলিম সমাজে নারী নিগ্রহ ছিল স্বাভাবিক চিত্র।’
পূজাপার্বণে রাজবাড়িসহ হেমনগর আনন্দ উৎসবে জেগে উঠতো। জমিদারবাড়ির দক্ষিন আঙ্গিনায় (এখন যেখানে কলেজ মাঠ) ছিল দ্বিতল নাট্যশালা। এ প্রবন্ধকার ১৯৬২ সালে কৈশোর কালে রাজবাড়ি বেড়াতে গিয়ে ওই নাট্যশালা প্রত্যক্ষ করেন। হেমচন্দ্র চৌধুরী এবং তার বংশধররা সবাই ছিলেন উদার সংস্কৃতির সমঝদার। ওই নাট্যশালায় কোলকাতার নামীদামি শিল্পীরা এসে অভিনয় করতেন। যাত্রা পালা হতো দুর্গাপূজার সময়। কীর্তণের জন্য বিখ্যাত ছিল হেমনগর। রাজবাড়ির সামনের লনে বসতো কীর্তনের আসর। তবে নীচু জাতের হিন্দু এবং মুসলমানের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিলনা। রাজবাড়ির উত্তরপূর্বে সড়কের ত্রিমোহনায় ছিল লোহার ব্রিজ। হেমনগর থেকে আমবাড়িয়া এবং হেমনগর থেকে গোপালপুর যাওয়ার সড়ক নির্মান করেন হেমচন্দ্র। রাজবাড়ির অনতিদূরে লাল রংয়ের এ লোহার ব্রিজ দেখার জন্য প্রজারা ভিড় করতো। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ ব্রীজের অস্তিত্ব ছিল। পরে হেমনগর-গোপালপুর সড়ক পাকা হলে জমিদারের শেষ চিহ্ণ লাল লোহার ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলা হয়। এ ব্রিজ থেকে সামনে এগুলে হাতের বায়ে পড়তো জমিদারের সুদৃশ্য বাংলো। লাল ইটের পুরু দেয়ালের উপর টাইলসের ছাউনী। চর্তুদিকে কোমর সমান দেয়াল। ঢুকতে লাল রংয়ের লোহার গেট। ছিল দেশবিদেশী ফুলের বাগান। চব্বিশ পাহারা চৌকিদার পাহারা দিত গেট। রাজকীয় মেহমানরা এখানেই থাকতেন। বাংলোর উত্তর ও পূর্বে ছিল দিগন্ত বিস্তৃত গরিল্লা বিল। মাঝে দ্বীপসম যোগির ঘোপা। কোলকাতা থেকে জমিদারের আত্মীয়স্বজন অথবা ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের কেউ এলে বাংলোয় অবস্থান করতেন। পানসি নৌকায় চড়ে বিপুল জলরাশিতে ডুবে থাকা গরিল্লা বিলে নৌবিহার করতেন রাজঅতিথিরা। হেমনগর জমিদারের স্মৃতিবিজড়িত যোগির ঘোপা এখনো টিকে রয়েছে। অস্তিত্ব হারিয়েছে জমিদারের ডাকবাংলো। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এ প্রতিবেদক সুদৃশ্য ডাকবাংলো দেখেছেন। এখন গেলে বুঝায় যায়না যে একদা এখানে বাংলো ঘর ছিল। ভূমিদস্যুরা জালকাগজপত্র তৈরি করে প্রথমে বাংলো ঘরটি ভেঙ্গে ফেলে। পরে জমি দখল করে নেয়। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হেমনগর পরী দালাল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদেও ঘাটি। এখান থেকেই কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার ও বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
হেমনগর জমিদাররা প্রজাবৎসল হলেও তাদের বিরুদ্ধে রায়তদের কিছু সুনিদিষ্ট অভিযোগ ছিল। সেগুলোর নিরপেক্ষ যাচাই কখনোই হয়নি। এখনো সে চেষ্টা নেই। শুধু হিন্দু বা শুধু মুসলমান এ ভেদবুদ্ধিতে অভিযোগ আনা বা মূল্যায়ন করা হয়েছিল মনে অনেকেই মনে করেন। এর কোনো কোনোটি হয়তো প্রশাসণত্রুটিজনিত, সস্তা ধর্মীয় আবেগ বা যুগধর্মজাত। বকেয়া খাজনার জন্য প্রজাপীড়ন করতো সব ভূস্বামীরাই। ব্রিটিশদের পাওনা সময়মত পাওনা পরিশোধ করলে না করলে কেমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয় নাটোরের জমিদারদের পুকুরিয়ার তালুক নীলামে বিক্রি স্মরণ করা যেতে পারে। সে যাই হোক হেমনগর জমিদারের নায়েব কার্তিক রায়কে নিয়ে এখনো একটি গল্প চালু রয়েছে। যেমন নায়েব কার্তিক খাজনা আদায়ের জন্য প্রায়ই প্রফুল্লনগর ( বর্তমানে সৈয়দপুরে অবস্থিত তহশীল কাচারি) রাজকাচারিতে যেতেন। একদিন জগন্নাথবাড়ি গ্রামের রায়ত আলীম হোসেনকে বকেয়া খাজনার জন্য ভৎসর্না করে বলেন, ‘ হেমবাবুর উর্বর জমিতে তোরা একটি করে ধান বুনে ছড়ায় ৫/৬শ করে ধান পেয়ে থাকিস। এতো ধান হবার পরেও কেন নিয়মিত খাজনা দিসনা? ওই রায়ত উত্তরে বলেছিলেন, ‘বাবু এক শিচায় (শিষ) যেমন অনেক ধান জন্মে তেমনি এক লোহমায় অনেক ভাত পেটে যায়। এজন্য পেটের খোরাক জোগানোর পর বেশি কিছু থাকেনা। এজন্য খাজনা দিতে পারিনা।’ গল্পটি সত্যমিথ্যা যাই হোক। এলাকায় খুবই প্রচলিত। আশির দশকে হেমনগর কলেজে অধ্যাপনার সময় এ প্রতিবেদক এ গল্পটি একাধিকবার শুনেছেন হেমনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম শাহেনশাহ খান এবং হেমনগর গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি মরহুম সেকান্দর আলী তালুকদারের মুখে। হেমনগর জমিদারের দাপট দেখেছেন এমন অনেক প্রজা যেমন কাহেতার মরহুম আনিসুর রহমান এ প্রতিবেদকে প্রায়ই বলতেন, রাজবাড়ির পূর্ব পাশের সড়ক দিয়ে কেউ ছাতা মাথায় অথবা জুতো পায়ে হেটে যেতে পারতেন না। জমিদারের লাঠিয়ালরা বাধা দিতেন। শাস্তি দিতেন। প্রতিবেদকের ধারনা নীচু শ্রেণীর রাজকর্মচারির্ াঅতিরিক্ত প্রভূভক্তি দেখাতে গিয়ে এ বাড়াবাড়ি করতো। এ ঘটনা হেমনগর জমিদারের অহংবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো। সাধারন প্রজাদের মধ্যে সৃষ্ট এ অসন্তোষ পরে প্রতিহিংসায় পরিণত হয়। জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর বংশধরদের এখনো যারা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকেন তাদের অন্যতম হলেন শিমলাপাড়া গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুস সালাম মেম্বার। তিনি জানান, এ বংশের কমল গাঙ্গুলীর সাথে তার যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল। তিনি ছিলেন একজন নামকরা ফুটবলার। সঙ্গীতে তার প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তিনি বংশ পরিচয় দিতে গিয়ে জানান, জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর চার পুত্র ছিল। এরা হলেন হেরম্ভ চৌধুরী, গঙ্গেশ চৌধুরী, প্রফুল্ল চৌধুরী ও যোগেশ চৌধুরী। এরা সবাই ছিলেন কোলকাতার গ্রাজুয়েট অথবা পোস্ট গ্রেজুয়েট। তৃতীয় পুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র চৌধুরী ছিলেন বিখ্যাত ফুটবলার। পূর্ব বঙ্গ ছাড়াও রাজধানী কোলকাতায় দাপুটে ফুটবলার হিসাবে সুনাম ছিল। হেমচন্দ্রের চার কণ্যারা সবাই ছিলেন বিদুষী ও রুপবতী। এরা হলেন সুরেন্দ্র বালা দেবী স্বামী সতীশ চন্দ্র মুর্খাজী, কিরণ বালা দেবী স্বামী বাদল মুখার্জি, সুমতি বালা দেবী স্বামী মুরলীধর গাঙ্গুলী এবং সুনীতি বালা দেবী স্বামী অজ্ঞাত। সুমতি বালার স্বামী মুরলী ধর গাঙ্গুলি হেমনগর ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ভোটাভুটির জয়পরাজয় নিয়ে কৃষক নেতা হাতেম আলী খাঁনের সাথে জমিদার পরিবারের বিরোধ তৈরি হয়। পরবর্তীতে এ বাম নেতার সহিংস আন্দোলনে জমিদার পরিবার দেশত্যাগে বাধ্য হন।
হেমচন্দ্র চৌধুরীর তিন বোনসহ এ সভ্রান্ত পরিবারের সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং মার্জিত রুচির পরিচায়ক। এদের উন্নত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল নিয়ে পুরো পূর্ব বঙ্গ জুড়ে সুনাম ছিল। এ পরিবারে এক ডজন সদস্য ছিলেন ব্রিটিশ প্রশাসণের আই.সি.এস কর্মকর্তা। হেমচন্দ্রের সুযোগ্য ভগ্নীরা হলেন স্বর্নময়ী দেবী স্বামী নীলকান্ত গাঙ্গুলী, ক্ষিরোদা সুন্দরী দেবী স্বামী গোবিন্দ্র চন্দ্র গাঙ্গুলী এবং বারোদা সুন্দরী দেবী স্বামী রজনী কান্ত গাঙ্গুলী। এদের মধ্যে স্বর্ণময়ী দেবীর পুত্র ছিলেন শ্যামাকান্ত গাঙ্গুলী। শ্যামাকান্ত গাঙ্গুলীর পুত্র কেদারনাথ গাঙ্গুলী। আর কেদারনাথ গাঙ্গুলীর পুত্র হলেন কমল গাঙ্গুলী। কমল গাঙ্গুলীর সুযোগ্য কণ্যা হলেন পশ্চিম বঙ্গের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী পৌলমী গাঙ্গুলী। শিমলাপাড়া গ্রামের আব্দুস সালাম মেম্বার আব্দুস সালাম জানান, ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলী পৌলমী গাঙ্গুলীর ভাই। অবশ্য এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। কমল গাঙ্গুলীর কণ্যা ওপার বাংলার এ গুণী শিল্পী পৌলুমী গাঙ্গুলী সম্প্রতি হেমনগর রাজবাড়ি পরিদর্শনে আসেন।
হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৯২৫ সালে কাশীতে মারা যান। দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগের আগে ৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়ে হেমনগর জমিদারের উত্তরসূরিরা প্রায় সবাই পশ্চিম বঙ্গে পাড়ি জমান। শুধু শ্যামাকান্ত গাঙ্গুলী ও তার পুত্র কমল গাঙ্গুলী দেশের মায়া ছাড়তে না পেরে হেমনগরে থেকে যান। পূর্বেই বলা হয়েছে, কমল গাঙ্গুলী ছিলেন বিখ্যাত ফুটবলার ও সাংস্কৃতিক কর্মী। দেখতেও ছিলেন সুপুরুষ। প্রমিত বাংলায় কথা বলতেন। ১৯৬৫ সালে পাকভারত যুদ্ধের সময় একদল দুর্বৃত্তের দ্বারা গোপালপুর উপজেলায় পুনরায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। এরা কাবারিয়াবাড়ি গ্রামের বেশকটি হিন্দু বাড়িতে আগুন দিয়ে লুটপাট করে। ভেঙ্গুলা বাজারের হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। এরুপ পরিস্থিতিতে হেমচন্দ্র চৌধুরীর শেষ উত্তরসূরিরা দেশত্যাগ করেন। আজ হেমনগর জমিদারের উত্তরসূরিরা নেই। তবে তাদের যশ, খ্যাতি, সুনাম-বদনাম মিলেমিশে জাগরুক রয়েছে। গোপালপুর উপজেলার অনেক প্রবীণ যারা এখনো বেঁচে রয়েছেন তারা হেমনগর রাজবাড়ি ও জমিদার পরিবারের স্মৃতি চারণ করেন। আমার বাবা ৯৩ বছর বয়সী মোহম্মদ হাতেম আলী খাঁন প্রায়ই হেমনগর জমিদারদের নিয়ে স্মৃতি চারণ করেন। আমার দাদা উমর আলী খাঁন ছিলেন তাদের প্রজা। আমার বাবার দাদা বরহ উদ্দীন খাঁন বগুড়া এলাকা থেকে আগমন করে চাতুটিয়া মৌজায় বসবাস শুরু করেন। হেমনগর নায়েবকাচারি থেকে দেয়া একটি কবুলিয়ত দলিলমূলে বরহউদ্দীন খান হেমনগরের প্রজা হিসাবে কিছু জমি ভোগ করার অধিকার পান। দাদার নিকট থেকে পাওয়া ওই ধরনের একটি জীর্ণ দলিল আমার বাবা দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করেন। তিনি স্মৃতিচারণ করে জানান, মাঘ মাস এলে খাজনা আদায় উপলক্ষে রাজগোলাবাড়ি এলাকায় হেমনগর জমিদাররা ঘটা করে প্রজা দর্শন দিতেন।
হেমচন্দ্রের বংশধর কমল গাঙ্গুলী ২০১২ সালে কোলকাতায় দেহত্যাগ করেন। কমল গাঙ্গুলীর কণ্যা পৌলমী গাঙ্গুলী পুর্বপুরুষের ভিটেমাটি দেখার জন্য সম্প্রতি কোলকাতা থেকে হেমনগরে আসেন। তিনি হেমনগর রাজবাড়ি, রাজকাচারী, রাজদীঘিসহ প্রতিটি স্থান ঘুরে দেখেন। বাবা ও ঠাকুরদাদার মুখে গল্প শোনা জমিদার বাড়ির সেই ঐতিহ্য হাতড়ে বেড়ান। রাজবাড়ির প্রতিটি অন্দর তন্ন তন্ন করে পূর্ব পুরুষের স্মৃতি খুঁজে বেড়ান। প্রধান ফটকের সামনে বহুক্ষন বিমর্ষে দাড়িয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। পরে সেখান আসেন গোপালপুর প্রেসক্লাবে। স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময় করেন তিনি। মত বিনিময়ের সময় আবার তাকে আবেগপ্রবণ চেহারায় দেখা গেছে।
পৌলমী জানান, ফেসবুকে ময়মনসিংহের শিল্পী রাণার সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি শেকড়ের সন্ধানে আসেন। নিজ চোখে তৃপ্তি ভরে সব দেখেন। যেন নিজ বাড়ি এসেছেন। রাজবাড়িতে কলেজ প্রতিষ্ঠা ভালো হয়েছে। তবে ভেতরটা খুবই নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন। ভবন উন্নয়নের নামে রাজবাড়ির মূল কাঠামো ও সৌন্দর্যের ক্ষতি করা হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, অনণ্য স্থাপত্যরীতির ভবনটি সঠিকভাবে সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষণ করা হবে। পরবর্তী প্রজন্ম তা দেখতে পারবে। এ বাড়িকে কেন্দ্র করে সরকারের আইটি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনায় অসন্তোষ প্রকাশ করে জানান, এতে রাজবাড়ির প্রতœতাত্বিক বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসময়ে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা পুলিশ স্টাফ কলেজের ডিরেক্টর (প্রশাসণ) ইকবাল হোসেন, সঙ্গীত শিল্পী আশরাফুল হুদা ও রাণা এবং উপজেলা বিএনপির সম্পাদক আবু মুনিম ঈসা।
এদিকে ৭০ বছর পর হেমনগর জমিদার পরিবারের সদস্যের রাজবাড়ি পরিদর্শণের খবরে সাড়া ফেলে। তাকে একনজর দেখার জন্য মানুষের ভিড় জমে। হেমনগর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার আব্দুস সালাম জানান, হেমচন্দ্র চৌধুরি ছিলেন দারুন শিক্ষানুরাগী। ১৯০০ সালে হেমনগরে বিমাতার নামে ২০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠা করেন শশীমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। গোপালপুর সূতী ভি এম পাইলট হাই স্কুল এবং পিংনা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি জমি ও অর্থ দান করেন। আনন্দমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠায় শিলালিপিতে দশজন দাতার তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে তার নাম। তিনি নগদাশিমলা ইউনিয়নের সৈয়দপুরে প্রফুল্লনগর রাজকাচারি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রজাসাধারনের পানীয় জলের সুবিধার্থে রাস্তার মোড়ে মোড়ে কুপ এবং বহুসংখ্যক পুকুর খনন করেন। তিনি চট্রগ্রামের সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির ও টাঙ্গাইল ফৌজদারী উকিলবার প্রতিষ্ঠায় সার্বিক সহযোগিতা করেন। তবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্পে দূষিত তদানিন্তন রাজনীতি ও একপেশে অপপ্রচার তার অনেক মহৎ কর্মকে আড়াল করেছে। হেমনগর শশীমূখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক জোয়াহেরুল ইসলাম বিএসসি জানান, হেমচন্দ্র চৌধূরী যদি কোন প্রজাকল্যাণকর কাজ নাও করতেন তবু শুধুমাত্র শশীমুখি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি প্রজাদের হৃদয়ে জাগরুক থাকতেন। সেআ যুগে শুধু হিন্দুরা নয় দরিদ্র মুসলিম পরিবারের সন্তানরাও এখান থেকে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা গ্রহন করেছে। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে তিনি মানুষের মাঝে এখনো বেঁচে রয়েছেন। পাকিস্তানী শাসনের তেইশ বছর এদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বহাল থাকায় হেমচন্দ্র চৌধুরী ও তার বংশধরদের কৃতিত্ব ছাইচাপা দেয়া হয়। নতুন প্রজন্ম এদের প্রজা কল্যাণমূলক হাজারো কাজের শত ফিরিস্তি সম্পর্কে জানেনা। সমসাময়িক জমিদার শ্রেণীর প্রচলিত দোষত্রুটির উর্ধে না থাকলেও হেমচন্দ্রের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পূর্ণ ও একপেশে ইতিহাস বর্ণনা বাতিল করে প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে জানাতে হবে। জমিদারি প্রথা বাতিলের মাধ্যমে আমরা নতুন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে প্রবেশ করলেও সে যুগের ইতিহাসের প্রবাহমান ঘটনার দায় বা পুরস্কার থেকে কাউকে বিযুক্ত করা যাবেনা।
প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের গোপালপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি, দৈনিক ইত্তেফাকের স্থানীয় প্রতিনিধি এবং মধুপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।