মুন্নাফ হোসেন, ময়মনসিংহ থেকে : সোমবার পৌষের শেষ বিকেলে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ার ২শ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুম গুটি খেলা প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও জমিদার আমলের তালুক-পরগনার সীমানায় অনুষ্ঠিত হবে।
খেলাকে ঘিরে উপজেলার সর্বত্রই উৎসবের আমেজ বিরাজ করেছে। উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে লক্ষীপুর ও দশ মাইলের মাঝামাঝি বড়ই আটা নামক বড় মাঠ হলো খেলাটির কেন্দ্রস্থল।
মুক্তাগাছা জমিদাররাজা শ্রী শশীকান্ত বাহাদুরের সাথে ত্রিশালের বৈলরের হেম চন্দ্র রায় জমিদারের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। জমিদার আমলের শুরু থেকেই তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের ভূ-খন্ডে দুই নীতির প্রতিবাদে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। জমির পরিমাপ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মিমাংসা কল্পে লক্ষীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে যেখানে শুরু তালুক পরগনার সীমানা সেখানে এ গুমগুটি খেলার আয়োজন করে।
গুমগুটি খেলার শর্ত ছিল গুটিটি যে দিকে যাবে তা হবে তালুক পরাজিত অংশের পরগনা। জমিদার আমলের সে গুটি খেলায় মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয়। আজও তালুক- পরগনার জমির পরিমাপ একইভাবে চলছে। ১ মণ ওজনের পিতলের গুটি ডাক ঢোলের তালে-তালে নেচে গেয়ে তালুক-পরগনার সীমানায় নিয়ে আসার পর গুটির উপর ‘জিততই আবা দিয়া গুটি ধররে’ এ ম্লোগান মুখে নিয়ে এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়বে হাজার হাজার মানুষ।
গুটি খেলায় টানা হেচড়া সবই হয় কিন্ত হয়না কোন মারামারী কাটাকাটি। হাজার হাজার মানুষ নিয়ন্ত্রনে থাকে না কোন পুলিশ বা অন্য কোন আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।
এ খেলায় আজ পর্যন্ত ঝগড়া বিবাদের কোন ঘটনা ঘটেনি। ৭/৮ বছর আগে মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ঠ হয়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছিল বলে এলাকাবাসী জানান। প্রায় ২শ বছর ধরে এ খেলাটি স্থানীয়বাসী চালিয়ে আসছেন বলে জানিয়েছেন লক্ষিপুরের প্রবীন গুমগুটি খেলোয়ার ওয়াজ উদ্দিন মন্ডল (৭৬)।
লক্ষীপুরের বয়োবৃদ্ধ ইয়াকুব আলী (৮৭) পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে স্থানীয় ভাবে খেলাটির আয়োজন করে আসছেন। জমিদারী আমলের পর ও তার পুর্ব পুরুষ খেলাটি ধরে রেখেছিলেন বলে জানান ইয়াকুব আলী। সেই থেকে ফুলবাড়ীয়ার ঐতিহ্যবাহী গুমগুটি খেলার অঘোষিত কতৃপক্ষ তাদের পরিবার। প্রতি বছর পৌষের শেষ বিকালের এ খেলাকে ঘিরে অতি প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষীপুর, বড়ই আটা, ভাটিপাড়া , বালাশ্বর, শুভরিয়া,কালীবাজাইল, তেলিগ্রাম, সারুটিয়া, গড়বাজাইল, বাসনা, দেওখোলা, কুকরাইল, বরুকা, আন্ধারিয়া পাড়া, দাসবাড়ী, কাতলাসেন সহ আশে পাশের ১০/১২টি গ্রামে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। ছোট ছোট ছেলে- মেয়েরা পড়ে নতুন নতুন জামা কাপড় ,শতাধিক গরু জবাই হয় গ্রামের বিভিন্ন স্থানে। গুটি খেলা এক নজর দেখার জন্য দূরদূরান্তের আত্বীয়স্বজন ভীড় করে গ্রামে, চর্তুদিকে উচ্চ স্বরে মাইক বাজে। ঢাক-ঢোলের বাজনার তালে তালে গ্রামের আবাল- বৃদ্ধবণিতা নেচে ওঠে।
ঐতিহ্যবাহি গুম গুটি খেলা এক নজর দেখার জন্য সকাল থেকে পার্শ্ববর্তী মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ সদর, ত্রিশাল, ভালুকা উপজেলা থেকে শত শত মানুষ ভীড় করে খেলা স্থলে। তালুক পরগনার সীমানা লক্ষীপুর গ্রামের বড়ই আটা নতুন ব্রীজ। যেখানে ২শ বছর আগে জমিদারের প্রজারা খেলে ছিল শক্তি পরিবার এ অদ্ভুদ খেলা। হাজার হাজার গুমগুটি খেলোয়াড়ের ১ মণ ওজনের গুমগুটি টানা হেচড়ার পর হঠাৎ করেই গুমগুটি হারিয়ে যায়, এ জন্য খেলাটির নাম করণ করা হয়েছে গুম গুটি।