জাহিদ কবীর হিমন, জার্মানী থেকে : কতকাজে কতভাবে সময় চলে যায়। কতকিছু পেছনে পড়ে রয়। কতকিছু ভুলে যেতে হয়। এরই মাঝে কিছু জিনিস অকারণে হলেও বয়ে বেড়াতে হয়। আশির দশক হতে শুরু করে টানা তিন দশক কয়েক প্রজন্মকে অহর্নিশ নির্মল আনন্দদান করে হুমায়ূন আহমেদ যে উদাহরণ তৈরি করেছেন যার ফলেই সময় অতিবাহিত হওয়ার মাঝেও তাঁকে আমাদের সাথে করে বয়ে বেড়াতে হয়, ধারণ করতে হয়। জীবনে আনন্দই মুখ্য, ছোট্ট এই জীবনে তাই আনন্দে থাকা অতি জরুরী। এই জরুরী কাজে তিনি অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখে আমাদের ঋণী করেছেন।

বলা হয়ে থাকে সাহিত্যের গুণগত মান সেটির জনপ্রিয়তা দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়। ক্ষেত্র বিশেষে তা অসত্য নয়। তাই আমরা বলতে সাহস করি যে হুমায়ূন আহমেদের সব লেখাই গুণগত মান ধরে রাখেনি। একথা তিনিও বহুবার স্বীকার করেছেন। তবে আমরা বলতে পারি, অনেক বোদ্ধা সাহিত্যিকও জনমনের ভাষা ধরতে পারেননি। তিন বছর গবেষণা করে সাতশ পাতার একটি বই লিখে ঠিকমত রয়্যালটিও তুলতে পারেননি। অপরদিকে এর রাতে লিখিত হুমায়ূন আহমেদের একটি বই কেনার জন্য বইমেলায় সে কী জনস্রোত সে কী উন্মাদনা! এমতাবস্থায় সেই বোদ্ধা লেখক সাহিত্যক অন্তর্জ্বালায় জ্বলে যদি পত্রিকায় এক আধটু লিখেন তবে তা খুব যে ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না সে কথা জোর দিয়েই বলা যায়।
বলছিলাম গুণগত মান নিয়ে কথা। সংখ্যা বাড়লে মানের প্রশ্ন গৌণ হয়ে যায়। তবে অনেক বই আছে তাঁর যা পাঠক মহলে শুধু হুমায়ূন আহমেদের বই বলে নয় বরং সব দিক দিয়ে মানসম্মত বলেই তা সমধিক প্রচার পেয়েছে। ‘জোসনা ও জননীর গল্প’, ‘মাতাল হাওয়া’, ‘মধ্যাহ্ন’ ‘একাত্তর’ বা ‘সূর্যের দিন’ ইত্যাদি বই শুধু সাহিত্যমানের জন্যই জগণনন্দিত হয়নি বরং এসব বইয়ের প্রেক্ষাপট কাহিনীচিত্র চরিত্রের বিন্যাস ইত্যাদি কোনক্রমেই বিশুদ্ধ সাহিত্যের চেয়ে নিচে নয়। অন্যদিকে তাঁর সৃষ্ট কিছু চরিত্র বাংলা সাহিত্যে আরও বহুকাল দাঁপিয়ে বেড়াবে সন্দেহ নাই। মিসির আলী ও হিমু যেন স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদকেই ধারণ করে বইয়ের পাতায় বিচরণ করেছে। এই দুই চরিত্রের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচারেরও বহু মিল রয়েছে।
 |
হুমায়ুন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২) |
হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলার কিছু নাই। সবাই সবই জানে। আমি তাঁর প্রতিটি ছবি দেখেছি। এর মাঝে ‘শ্যামল ছায়া’, ‘চন্দ্রকথা’ ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ দেখা হয়েছে একাধিকবার। ‘শ্যামল ছায়া’ দেখে একদিকে হেসেছি, পরক্ষণেই চোখে জল আনার মত দৃশ্যায়ন। এমনটা সম্ভব শুধু হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই। সর্বশেষ দেখেছি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। এ ছবির পটভূমি আর তদানুযায়ী স্থান নির্বাচন কতখানি অদ্ভুত সুন্দর হয়েছে তা ছবিটি না দেখলে বোঝা দুষ্কর।
হুমায়ূন আহমেদ বই বা চলচ্চিত্রের আগেই যে মাধ্যমটির মাধ্যমে জনমনে স্থান করে নিয়েছিলেন তা হল নাটক। একজন নাট্যকার কতখানি সফল তা একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের এক অনবদ্য চরিত্র বাকের ভাই। সবাই জানে এই কাহিনী। নাটকের শেষে এই বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হয়। নাটকের দর্শকেরা তা মানতে নারাজ। তার ফাঁসি যাতে না হয় সে কারণে ওই সময় পাড়া মহল্লায় মিছিল মিটিং হয়েছিল। বিটিভি ঘেরাও পর্যন্ত করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলে মিলাদ মাহফিলের ধুম পড়ে যায়। আমি নিজে এই ঘটনাগুলো দেখিনি বা তখন বয়স হয়নি। পরবর্তীতে এসব যারা করেছে তাদের মুখে তো বটেই অনেকের লেখা হতেও জানতে পেরেছি।
হুমায়ূন আহমেদের কিছু কিছু বইয়ের মত তাঁর শেষ দিকের নাটকের মান নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলে। নিন্দুকের মুখে ছাই দিলাম। ওদের কথা আর নয়। ২০০৪ এর দিকের একটি নাটকের কথা এখানে না বললে আমার কাছে লেখাটি অপূর্ণ ঠেকবে। নাটকটির নাম ‘উড়ে যায় বকপক্ষি’। ছাব্বিশ পর্বের ধারাবাহিক
এই নাটকটি গত আট বছরে কতবার যে দেখা হয়েছে তা হিসেব করে বলা দুষ্কর। তবে এই নাটকের একটি প্রতিঘাত আমার জীবনে তৈরি হয়েছিল। নাটকের প্রতিটি চরিত্র প্রতিটি ডায়ালগ আমার মুখস্ত। অবস্থা এমন যে চলতে ফিরতে সেই সুরে সেই ডায়ালগগুলো দিতে দিতে বন্ধু মহলে আমি বিশেষ হুমায়ূন ভক্ত হিসেবে পরিচিতি পাই।
তিনি চলে গেছেন, আর ফিরবেন না। তাঁর জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে তাঁর ঘরোয়া সংগঠন ফুল ওল্ডস ক্লাবের কোন আদিখ্যেতা নেই। আমাদের মনেও আনন্দের বাতারবরণ নেই। আমাদের শুরু একটিই আনন্দ যে, তিনি ছিলেন একজন যিনি দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন তিন দশক ধরে, এদেশের সাহিত্য প্রেমী তরুন তরুণীদের মনে। তাঁর মৃত্য নেই। সাহিত্য যিনি তৈরি করেছেন দৈহিক প্রস্থান তাঁর অনুপস্থিতি টের পেতে দিবে না। জন্মদিন তাই ফিরে ফিরে আসবে যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, কন্সটাঞ্জ ইউনিভার্সিটি, জার্মানী।
উপদেষ্টা সম্পাদক, টাঙ্গাইল বার্তা।