ঢাকা শনিবার, জুন ৩, ২০২৩

Mountain View



টিভি সিরিয়ালে পুড়ছে ঘর ভাঙছে সংসার

Print Friendly, PDF & Email
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : মানুষ স্বভাবতই বিনোদন প্রিয়। শতো ব্যস্ততার মাঝেও তারা একটু বিনোদন খোঁজে। দুখের সাগরে ডুব দিয়েও সুখের মণি-মুক্তো আহরণ করতে চায়। এটা মানুষের স্বভাবজাত চিরন্তনধারা। আপামর মানুষের বিনোদন আকাঙ্খা নিবারণ করতে একদল মানুষ বিনোদন দিতে দিনরাত খেটে মরে। মনের ক্ষুধা মেটানোই তাদের স্বার্থকতা। মানুষের ক্ষুধা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত।
circut_1371909987_3-6968542622_cd6105cfbc_z
পেট, দেহ ও মনের ক্ষুধা। পেটের ক্ষুধার জন্য প্রয়োজন পরিশ্রম, দেহের ক্ষুধার জন্য প্রয়োজন সঙ্গম আর মনের ক্ষুধার জন্য প্রয়োজন বিনোদন। বিনোদনকে আবার তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়, সুস্থধারার বিনোদন, অসুস্থধারার বিনোদন এবং বাণিজ্যিকধারার বিনোদন। যদিও সবগুলোই বাণিজ্যিক; তবুও বাণিজ্যিকধারার লক্ষ্যই শুধু অর্থ উপার্জন করা। সমাজের জন্য বা মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সেখানে নেই। বিবেচনা করা হয় না ইতিবাচক কি নেতিবাচক কোনো দিকই। সেই অসুস্থধারার বাণিজ্যিক বিনোদনের আদি-অন্তের কিছু রূপরেখা তুলে ধরা হলো।
310712115628sjtapurtupu
সেদিন রাতের কথা। তাড়াহুড়ো রান্না শেষ করে ঘরে এলেন গৃহবধু। বসলেন টিভির সামনে। স্টার জলসায় ‘মা’ ধারাবাহিক শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তড়িঘড়ি চুলোর আগুন ভালোভাবে নিভিয়ে আসেননি। আধঘণ্টা কি পয়তাল্লিশ মিনিট পর বাইরে আগুন-আগুন চিৎকার শুনতে পেলেন। পাশের বাড়ির ঘটনা ভেবে এতে তেমন কর্ণপাত করেননি। হাফাতে হাফাতে একজন ছুটে এসে বললো, ‘তোমার রান্না ঘরে আগুন লেগেছে। আর তুমি বসে বসে টিভি দেখছো?’ আগন্তুকের কথা শুনেই ছুটে গেলেন বধু। উঠোন ভর্তি লোকজন। প্রতিবেশিরা ছুটে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে প্রায়। উপস্থিত লোকজন গৃহবধুকে বেশ বকাঝকা করলেন। ‘এই টেলিভিশনেই জগতটা খাইলো।’ ঘটনাটি মাদারিপুরের কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের ‘ময়দান’ নামক স্থানের।
ATN_St10
এ থেকে বোঝা যায়, ঘরে আগুন লাগে লাগুক। বাচ্চা খাবারের জন্য কাঁদে কাঁদুক। স্বামী যা বলে বলুক, তাতে কী আসে যায়? টিভির এই সিরিয়ালটা তো মিস করা যায় না। আমাদের নারী সমাজ আজ এতোটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে এর ওপর; যার ফলাফল খুব বেশি ইতিবাচক নয়। কারণ এসব টিভি সিরিয়াল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দাম্পত্য সম্পর্কেও ফাটল ধরাচ্ছেন অনেকে। পারিবারিক সংঘাত, পরকিয়ার প্রতি আসক্তি, সংসারভাঙার মতো যাবতীয় কুট-কৌশল রপ্ত করছেন নারী সমাজ। প্রগতির নামে পরিবারের মধ্যে দূর্গতি ডেকে আনছেন। এসব প্রগতিশীল নারীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে গোটা পুরুষসমাজ।
ancholযদিও পারিবারিক বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম টেলিভিশন। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে সারা বিশ্বের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান উপভোগ করা যায় ঘরে বসে। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সভ্যতার চরম শেখরে অবস্থান করছি আমরা। এর দুটি দিক; একটি ইতিবাচক, অপরটি নেতিবাচক। আমরা বরাবরই নেতিবাচক দিকগুলোই গ্রহণ করি। কারণ প্রবাদ আছে, ‘আল ইনসানু হারিসুন ফি মা মুনিআ’ (আদিম কাল থেকেই মানব জাতির নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণটা বেশি)। হজরত আদম (আ.)-এর নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য হজরত হাওয়া (আ.)-এর সৃষ্টি। পুরুষ তার বিনোদন বা মনোরঞ্জনের জন্য নারীকে পেলো। নারীর প্রতি একটি মোহনীয় আবেশের জন্ম নিলো। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নিষেধ করলেন ‘গন্ধম’ খেতে। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় পরে হজরত হাওয়া (আ.)-এর সম্মতিক্রমে ‘নিষিদ্ধ ফল’ খেলেন উভয়েই। সেইতো ভুলের শুরু। কথায় আছে, ‘আউওলুন নাসি আউওলু নাসিন’ (প্রথম মানব প্রথম ভুলের স্বীকার)।
bojhena
আমাদের পরিবারে অবসরে বিনোদনের জন্যই টেলিভিশন। এ ব্যাপারে জায়েজ-নাজায়েজের ব্যাপারটি তোলা রইলো। সারাবিশ্বে দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে টিভি চ্যানেল। এতে আপত্তি নেই; থাকবার কথাও নয়। কিন্তু আমাদের দেশের নারীরা স্বদেশীয় চ্যানেলের অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে আসক্ত হয়ে পড়েছে ভারতীয় কয়েকটি চ্যানেলের দিকে। পার্শ্ববর্তী বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারতের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি টিভি চ্যানেলের লাগামহীন দৌরাত্মে আমাদের নারী সমাজ প্রতিনিয়ত বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। এটা আকাশ সংস্কৃতির অবাধ উন্মুক্ততার ফসল। তবে একটা কথা না বললেই নয়, শুধু বাংলাদেশই ভারতীয় চ্যানেলগুলো প্রচারের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ভারত সরকার তার দেশে বাংলাদেশের একটা চ্যানেলের সম্প্রচারেরও অনুমতি দেয়নি। এ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আমরা আজও তাদের চ্যানেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারিনি। সে ব্যর্থতা আমাদের। তবুও আমাদের ভারতপ্রীতির কোনো কমতি নেই।
sansar
প্রসঙ্গত বলতে হয়, যে দেশের বিএসএফ আমাদের ‘ফেলানী’ কে নির্মম ভাবে হত্যা করে। বর্ডার দিয়ে অবাধে ফেন্সিডিল পাঠায়। ধ্বংস করে আমাদের যুবসমাজ। তাদের প্রতি আমরা কখনোই বিরাগভাজন হই না বা হতে পারি না। এ প্রসঙ্গে আমার পরিচিত এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কালকিনি শাখা সংসদের সভাপতি মাজহারুল আলম খুব আক্ষেপের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘ভারত টিভি সিরিয়ালের মাধ্যমে ধ্বংস করছে আমাদের নারী সমাজ। আর ফেন্সিডিলের মাধ্যমে ধ্বংস করছে আমাদের যুবসমাজ। আমাদের চালিকাশক্তি নারী ও যুবকদের মেধাশূন্য করার বন্দোবস্ত করছে তারা।’
ভারতের দুটি বাংলা চ্যানেল আমাদের দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাদের টিআরপি ক্রমশই বর্ধিষ্ণু। এর কারণও হয়তো বাংলাদেশের দর্শক। বাংলার ষোলো কোটি মানুষ তাদের দেখে। এতো পরিমাণ দর্শক ভারতেও হয়তো নেই। জনপ্রিয় বাংলা চ্যানেল দুটির নাম, স্টার জলসা ও জি বাংলা। একদিন আমার এক ছোটোবোন সোহাগীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চ্যানেল দুটিতে কী কী সিরিয়াল হয়’। ও গড় গড় করে স্টার জলসায় প্রচারিত জল নূপুর, ওগো বধু সুন্দরী, বধু কোন আলো লাগলো চোখে, ইস্টিকুটুম, মৌচাক, ভালোবাসা ডটকম, মা, টাপুর টুপুর, আঁচল, সখী, বধুবরণ এবং জি বাংলায় সতী, কেয়া পাতার নৌকো, সাত পাকে বাঁধা, রাশি, অগ্নি পরীক্ষা, কাছে আয় সই, বয়েই গেলোসহ আঠারোটি সিরিয়ালের নাম বললো। সবগুলো সিরিয়ালই ও দেখে। সন্ধ্যায় একবার টিভির সামনে বসলে রাত বারোটা অবধি একটার পর একটা চলতে থাকে। পরদিন সকালে আবার তার পুণঃপ্রচার করা হয়। রাতে কোনো কারণে যদি আপনি মিস করে থাকেন, তাহলে সকালে দেখে নেবেন। একেকটা সিরিয়াল বছরের পর বছর ধরে চলছে। তবু শেষ হওয়ার নামমাত্র নেই। আগে আমাদের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সকালে প্রত্যেকের ঘর থেকে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের সুমধুর সুর ভেসে আসতো। কিন্তু বর্তমানে এসব টিভি সিরিয়ালের টাইটেল সঙ্গীত শোনা যায় রাস্তা থেকে। কখনোবা বান্ধবী, নারী প্রতিবেশি কিংবা আত্মীয়-স্বজন একত্রিত হলে সংসারের ভালো-মন্দ খোঁজ না নিয়ে একে অপরের কাছে জানতে চায়, ‘টাপুর অ্যাকসিডেন্টের পর কি করলো?’, ‘রাতুল মাস্টার এখন কী করবে?’, ‘রাশি ধরা পড়ে গেলো কি না?’, ‘অজি কোথায় আছে?’, ‘দুষ্টু নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে কিভাবে?’, ‘রাজার আসলে কী করা উচিৎ?’সহ আরও কতো রকম কথা। যতোগুলো টিভি সিরিয়ালের কথা তুলে ধরা হলো, এর সবগুলোর প্রতি পুরুষের তুলনায় নারীরাই আসক্ত বেশি। তার যুক্তিযুক্ত একটা কারণও অবশ্য আছে। তাহলো, প্রত্যেকটি সিরিয়ালের কাহিনীতে পুরুষ চরিত্রগুলো থাকে গৌণ; আর নারী চরিত্রগুলো থাকে মুখ্য। মাঝে মাঝে মনে হয়, পুরুষ চরিত্রগুলোকে অনেক করুণা করে আনা হয়েছে। এতে আমাদের সমাজের নারীরা তাদের গুরুত্তও দিনদিন উপলব্ধি করছে। তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। ফলে অধিকতর সচেতনতার কারণে স্বামী বা সংসারের পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে কৌশল খাটাচ্ছে। তাদের প্রিয় নারী চরিত্রগুলো অনুসরণ করে তদ্রুপ আচরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। যে কারণে বর্তমানে সামাজিক অস্থিরতা ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব চরমভাবে বিরাজ করছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বিয়ের তিন দিনের মাথায় বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে। তিন সন্তানের জননী অবিবাহিত যুবকের হাত ধরে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসী স্বামীকে ফেলে কিশোর দেবরকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। স্বামীর অবর্তমানে পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে যোগাযোগ ও পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। এমনকি সম্প্রতি মেয়ের হাতে চাঞ্চল্যকর পুলিশ দম্পতি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে এই সোনার বাঙলাতে। হন্তারক মেয়ে ঐশি তার জবানবন্দিতে অকপটে স্বীকার করেছে, টিভি সিরিয়াল দেখে সে তার বাবা-মাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
sindoorkhelastarjalsha
এক সময় নারীরা স্বামীকে দেবতা কিংবা ফেরেশতার মতো জানলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিত্রটা ভিন্ন। স্বামীকেই এখন স্ত্রীর কথামতো চলতে হয়। নায়িকাদের পরনের ডিজাইন অনুযায়ী শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ তৈরি করে দিতে হয়। মায়েদের পাশাপাশি স্কুল-কলেজ পড়–য়া মেয়েরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সিরিয়ালের আদর্শ অনুযায়ী তার একজন বয়ফ্রেন্ড দরকার। আবার ভালো না লাগলে তাকে পরিবর্তন করে নতুন একজনকে গ্রহণ করাও ফ্যাশনে রূপান্তরিত হয়েছে। বান্ধবীর প্রেমিককে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করতেও তাদের দ্বিধা নেই। বলতে গেলে সভ্যতার নামে চরমভাবে অসভ্য হয়ে পড়ছে তারা। সিরিয়ালের প্রভাব শুধু ঘরেই নয়; বাইরেও চোখে পড়ার মতো। ভারতকে আমরা অনুসরণ করি। তাই ভারতে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর অতি উৎসাহী বাংলাদেশি বখাটে যুবকেরা তদ্রুপ ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন। একটা অপরাধ যেহেতু হাজারটা অপরাধের জন্ম দেয়। তাই আমাদের সমাজের মেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছেদে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। উদ্ভট-উচ্ছৃঙ্খল পোশাকে অভ্যস্ত হচ্ছে মেয়েরা। যেসব পোশাক টিভি সিরিয়ালগুলোতেই বেশি দেখা যায়। যৌন উত্তেজক পোশাক পড়ে নির্জনে পুরুষের পাশে ঘুরঘুর করলে পুরুষতো তার সদ্ব্যবহারের চেষ্টা করবেই। ফলে যতো বিপত্তি ঘটার তাই ঘটছে।
সিরিয়ালগুলোর বদৌলতে পরিবারেও চলে এসেছে বিশৃঙ্খলা। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে পুরো ঘরে একটা মাত্র টেলিভিশন থাকে। ফলে তার ওপর নির্ভর করতে হয় সকলকে। পুরুষরা সারাদিন বাইরে ব্যস্ততার পরে বাসায় এসে একটু দেশের খবরাখবর নেয়ার ইচ্ছে হয়। কিন্তু ননস্টপ সিরিয়ালের কারণে সংবাদ দেখার সুযোগ হয় না। কারণ রিমোট কন্ট্রোল নামের সোনার হরিণটি থাকে ঘরের কর্ত্রীর কাছে। তার মর্জি মতো দেখলে দেখো; নয়তো উঠে যাও। এ নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদেরও কমতি নেই। এমনকি সিরিয়াল চলাকালীন বাসায় কোনো মেহমান আসলেও বিরক্ত হন ঘরের স্ত্রী।
আরেকটি বাস্তব ঘটনা এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। বহুদিন পর এক দূর সম্পর্কের ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গেলাম । আগে নিয়মিত যেতাম সেখানে। তখন বাসায় ডিস লাইন ছিলো না। সবাই মিলে গল্প করতাম; আড্ডা দিতাম। ভালোই লাগতো। এখন আর তেমন যাওয়া হয় না। ভাবিই মাঝে মাঝে ফোন করে বলেন,‘ বাসায় আসো না কেনো?’ তাই সেদিন যাওয়া। গিয়ে দেখলাম, ভাবি টিভি রুমে বসে একা একা টিভি দেখছেন। ভাই খাটে ঘুমুচ্ছেন। বছরখানেক আগে ভাবিকে যেমন দেখেছি, আজ তার ব্যতিক্রম। টিভি ছেড়ে ওঠলেন না তিনি। তেমন ভালোভাবে কথাও বললেন না। শুধু বিজ্ঞাপনের সময় টুকিটাকি আলাপ। দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেকে দোকান থেকে মুড়ি-চানাচুর আনতে বললেন। আনার পরে বানিয়ে নিয়ে আসতে বললেন। মায়ের আদেশ মতো ছেলে সব কিছু ঠিকঠাক করে পরিবেশন করলো। মুড়ি খেতে খেতে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছি। ভাবি টিভি দেখেই চলেছে। সম্ভবত তখন ‘টাপুর টুপুর’ সিরিয়াল চলছিলো। রাত দশটা বেজে গেলো। ভাই উঠে গিয়ে রাতের খাবার নিয়ে আসলেন টেবিলে। আমরা দুজনে খেলাম। এরপর আমি চলে এলাম। আসার সময় ভাবিকে শুধু বললাম, ‘আপনি অনেক বদলে গেছেন।’ তারপর থেকে আর যাইনি সেখানে।
একবার নারী দিবসের এক সেমিনারে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি উপস্থিত নারীদের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনারা ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়ালগুলোর ওপর এতোটাই আসক্ত হয়ে পড়েছেন যে, এটা আপনাদের নেশাতে পরিণত হয়েছে। আপনার সন্তান কী করে, সে খবর আপনারা রাখেন না। আপনার সন্তান ঠিকমতো পড়ার টেবিলে বসে কি না, তাও খোঁজ নিয়ে দেখেন না কিংবা পড়ার টেবিলে বসলেও সে টেবিলে কী করছে তার খবর রাখেন না। আপনার মেয়ে গভীর রাতে কার সঙ্গে ফোনে কথা বলে, তার খোঁজ রাখেন না। আমার মনে হয়, দিন দিন আপনারা আপনাদের স্বভাবসুলভ চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসছেন। যার প্রভাব ইদানিং প্রতিটি পরিবারে লক্ষ্য করা যায়।’
কেবল ব্যবসায়ীদের বলেও এ চ্যানেলগুলো বন্ধ রাখা যায় না। কারণ, মাস শেষে ডিস লাইনের বিল আনতে গেলে নারী গ্রাহকরা বকে; টাকা দিতে চায় না। তাদের প্রথম প্রশ্ন,‘আজকে সিরিয়াল দেখতে পারিনি কেনো?’ ঘরের পুরুষ যেহেতু বাসায় থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে ডিস বিলতো নারীর কাছ থেকেই আনতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের পছন্দমতো চ্যানেল না থাকলে বকুনি শুনতে তো হবেই।
মূলত আমরা দেশজ সংস্কৃতির চেয়ে পরগাছা সংস্কৃতিকে লালন করে স্বাচ্ছন্দবোধ করি। আমরাই আমাদের নারী সমাজকে ঠেলে দিচ্ছি পরগাছা সংস্কৃতির দিকে। মনে হয় না, কোনো বছর শতকরা বিশজন নারী আমাদের জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান টেলিভিশনে উপভোগ করেছে। কারণ আমার আকাশ দখল করে রেখেছে স্টার জলসা, জি বাংলা, স্টার প্লাস আর জি টিভিরা। ‘টাপুর টুপুর’, ‘সাতপাকে বাধা’ আর ‘মা’ (ঝিলিক) আমাদের নারী সমাজের মগজ এমনভাবে ধোলাই করেছে যে, তারা ঐ সিরিয়াল দেখে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদবেন। ভুলেও চ্যানেল পাল্টে আমাদের দেশাত্মবোধক বিশেষ অনুষ্ঠান দেখবেন না। নুন খাই একজনের আর গুণ গাই অন্যজনের। ছি! আমরা কতোটাই অকৃতজ্ঞ। কবি যথার্থই বলেছেন, ‘ আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো টিভি পর্দায় যখন পাশ্চাত্যের/ হাঙর-সংস্কৃতি এসে গিলে খাচ্ছে পদ্মার রূপালি ইলিশ।’
আসুন! আমরা আমাদের অন্তরে স্বজাত্যবোধ জাগ্রত করি। নারী হৃদয়কে কোমনীয় করে তুলি। বস্তা পঁচা সিরিয়াল না দেখে বিনোদনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করি। যা আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য সুফল বয়ে আনবে। সবশেষে অতীব দুখের সঙ্গে বলি, পুলিশ কর্মকর্তাকন্যা ঐশির মতো কোনো মেয়ে যেনো ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখে তার বাবা মাকে হত্যার পরিকল্পনা করতে না পারে সে ব্যবস্থা করি। অবসরে সন্তানকে সময় দেই। এক্ষেত্রে মাকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিকারের দিকে না গিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলি। ‘বর্জন করি ছাইপাশ, সুখে থাকি বারো মাস’কাজে-কর্মে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই হোক আমাদের শ্লোগান।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

ফেসবুক মন্তব্য