লাইফ স্টাইল ডেস্ক
নিজেকে আর দশজনের থেকে আলাদা করে, হয়ত অনেকটা জোর করেই সবার চোখের সামনে মেলে ধরার একেবারে যথাযথ একটি উপায় হলো শরীরে উল্কি আঁকা। না, উল্কির ভক্ত মাত্রই যে অপরের মনোযোগপ্রার্থী, এমনটা বলা মোটেও উদ্দেশ্য নয়। বরং এটাই বলছি যে, এই উল্কিশিল্পের তীব্রতাই একে আর দশটি সাধারণ মাধ্যম থেকে আলাদা করে তুলেছে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত উল্কির চল বেশ কমই বলা যায়। তবে দিনদিনই উল্কির ফ্যাশন নিয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জাগছে আগ্রহ, সমানতালে শুরু হচ্ছে এই শিল্পের সমালোচনাও। সে বিতর্কে না গিয়ে ফ্যাশনের এই বিচিত্র এবং বর্ণিল ধারাটি সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
দিনদিনই বাড়ছে উল্কির চল
উল্কি আঁকার চলটা কোথা থেকে এলো সেটা আগে একটু দেখে নেয়া যাক। পলিনেশিয়ার আদিবাসী ভাষার শব্দ ‘ট্যাটাও’ থেকেই ইংরেজি ‘ট্যাটু’ শব্দটি এসেছে। আধুনিকতা বলতে আমরা যা বুঝি, তার প্রসারের অনেক আগে থেকেই উল্কির চল ছিলো মানব সমাজে। ধারণা করা হয়, প্রায় খৃষ্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দে গায়ের চামড়া কেটে নকশা করার যে দুঃসাহসিক প্রথার চল ছিলো, তাই কালানুক্রমে ট্যাটুতে রূপ নিয়েছে। বর্তমান বিশ্বেও ঐতিহ্যগতভাবে উল্কি ব্যবহারের প্রচলন রেখেছে এমন কতোগুলি জাতি হচ্ছে, উত্তর আফ্রিকার বার্বারের টামাজঘা, নিউজিল্যান্ডের মাউরি, এবং তাইওয়ানের আতায়া। এদের কাছ থেকে পশ্চিমের দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে উল্কির চল।
ক্যাপশন – মুখে উল্কি আঁকা একজন মাউরি
এছাড়া উল্কির উৎপত্তি সম্পর্কে আরেকটি প্রচলিত ধারণায় বলা হয়, একসময় কয়েদি ও ক্রীতদাসদের শরীরে এঁকে বিচিত্র চিহ্ন এঁকে তাদের আর দশজনের থেকে আলাদা করা হতো । ‘দাগি আসামি’দের গায়ের এই সব চিহ্নও ধীরে ধীরে উল্কির চলকে প্রভাবিত করেছে। ১৮৯৯ সালে ব্যাটারি চালিত এম্ব্রয়ডারি যন্ত্রে কালি জুড়ে দিয়ে প্রথম ট্যাটু মেশিন তৈরি করা হয়। বর্তমানে এর চল এতোটাই বেড়েছে যে, ইউরোপের দেশ জার্মানিতে ৩৪ বছরের নীচে প্রতি চার জনের একজন গায়ে ছোট-বড় নানা ধরনের উলকি আঁকা রয়েছে৷
গায়ে দেয়ার জন্যে যে ট্যাটু তাদের মূলত দুই ভাগে ভাগ করে নেয়া যায়। একটি স্থায়ী অর্থাৎ খুব বিশেষ চেষ্টা না করলে সেটা মোছার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। অন্যটি অস্থায়ী অর্থাৎ সহজেই মোছা যায়। যিনি নিজের শরীরের ট্যাটু বা উল্কি লাগাচ্ছেন, তা রুচি এবং তিনি নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করতে চান, তার ওপরেই নির্ভর করে উল্কি কেমন হবে এবং ঠিক কতখানি জায়গা জুড়ে হবে। অনেক সময় কারো বা পুরো শরীরেই উল্কি আঁকা হয় ৷ দেখে হঠাৎ মনে হবে, তিনি যে পোশাকটি পরেছেন, তার ডিজাইনটাই ওরকম৷
উল্কি আঁকা হয় যে যন্ত্র দিয়ে
কোনো উল্কি স্থায়ী হবে না অস্থায়ী হবে তা নির্ভর করে, কোন রাসায়নিক ব্যবহার করে উল্কি তৈরি করা হচ্ছে তার ওপর। সাধারণত আমাদের ত্বকের উপরের স্তরের কোষগুলো প্রতি ৬ থেকে ৮ সপ্তাহে নতুন করে তৈরি হয়। তাই অস্থায়ী উল্কি কোষগুলো যেহেতু কেবলমাত্র চামড়ার ওপরের স্তরেই লেগে থাকে, তাই এই ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে এরা ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যেতে শুরু করে। কিন্তু স্থায়ী উল্কি আঁকতে যে রঞ্জক বা রঙ ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর কণাগুলো অত্যন্ত বড় এবং সূঁচযুক্ত যন্ত্রের সাহায্য এইগুলো ত্বকের গভীরে রক্তের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। আমরা জানি, বাইরে থেকে কোনো বস্তুকণা আমাদের রক্তে প্রবেশ করলেই রক্তের শ্বেত কণিকা সেগুলো গিলে ফেলে বিনাশ করে দিতে চায়। উল্কি আঁকার রঞ্জক কণাগুলো রক্তে প্রবেশ করলেই শ্বেত কণিকাগুলো সেভাবেই ছুটে আসে এবং এই কণাগুলো গিলে ফেলতে চায়। কিন্তু রঞ্জক কণাগুলো তাদের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বড় হওয়ায় শ্বেত কণিকাগুলো তা করতে ব্যর্থ হয় এবং ঐখানে স্থায়ীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবেই চামড়ার অনেক গভীরে বাসা বেঁধে ট্যাটু বা উল্কি স্থায়ী রূপ পায়। বিদ্যুৎচালিত একটি যন্ত্রের সাহায্যে ট্যাটু বা উল্কি আঁকা হয়৷ যন্ত্রটি দেখতে তা ড্রিল মেশিনের মত। মেশিনের মাথায় রয়েছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি সুঁই৷ এই সুঁইটির মাথায় রঙ লাগনো থাকে৷ প্রতিবার সুঁইটি যখন চামড়ার ভেতরে প্রবেশ করানো হয় সেই সঙ্গে রঙও ভেতরে প্রবেশ করে৷ প্রতি সেকেন্ডে ১০০ থেকে ১৫০ বার এই সুঁইটি চামড়া ভেদ করে।
শরীরে উল্কি আঁকতে চাইলে থাকতে হবে ব্যাথা সহ্যের ক্ষমতাও
শরীরে উল্কি আঁকার ব্যাপারটি মোটেও ব্যাথামুক্ত নয়। সূঁচযুক্ত যন্ত্রের সাহায্যে চামড়া ফুটো করে এটি বসানো হয়। ব্যাথা কতটা তীব্র হবে, তা নির্ভর করবে দেহের যে জায়গায় উল্কি আঁকা হচ্ছে, সেখানকার চামড়া কতটা পাতলা। চামড়া যত পাতলা হবে, হাড় তত কাছাকাছি হবে এবং ব্যাথার মাত্রাও ততই বেশি হবে। তাই যেখানে মাংশপেশী বেশি এবং হাড় অপেক্ষাকৃত গভীরে সেখানেই উল্কি আঁকাটা ভালো। এছাড়া অনেক সময় শরীরে কিছু লেখার ক্ষেত্রে বানান এবং ডিজাইনের সূক্ষতার দিকে চোখ দেয়া দরকার। নাহলে নিচের ছবিগুলোর মতো সারাজীবন ভুল বানান এবং দৃষ্টিকটু ডিজাইন শরীরে নিয়ে ঘুরতে হবে।
বানান ভুলে হয়ে পড়তে পারেন হাস্যস্পদ
এবার আসা যাক উল্কি লাগানোর জন্যে শরীরকে কি খেসারত দিতে হয় তার সম্পর্কে। উল্কি আঁকার ফলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয় বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কারণ গায়ে উল্কি আঁকতে যে রং ব্যবহার করা হয়, সে রংয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই ঢুকে যায় শরীরের অনেক গভীরে । আর এটা ক্যান্সারের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া উল্কি আঁকার সময় সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না থাকলে সেখান থেকে ইনফেকশনও হতে পারে৷ বিশেষ করে উল্কি আঁকতে ব্যবহৃত হওয়া নিকেল থেকে অনেকেরই এলার্জি হয়ে থাকে৷