ঢাকা রবিবার, এপ্রিল ২, ২০২৩

Mountain View



রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে দিনগুলি

Print Friendly, PDF & Email

মোস্তাফিজুর রহমান : আমার বয়স তখন সবে বারো; সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। মাধ্যমিক স্কুলের শুরুর দিকের এই দিনগুলো সবার দৌড়-ঝাপ, হৈ-হুল্লড়, আনন্দ-ফূর্তি করেই কাটে। আমারও এসবের মধ্য দিয়েই দিন যাচ্ছিল। সেইসব দিনগুলোতে আধুনিক বাংলা গান খুব শুনতাম, বিশেষ করে তখনকার সমসাময়িক বাংলা গান। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, ক্রমশ পছন্দের গানের তালিকা আমার বাড়ন্ত বয়সের সাথে মিল রেখে একটা উগ্রতার দিকে ধাবিত হচ্ছে! একদিন চমৎকৃত হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমি আসলে আধুনিক বাংলা গান নয়, সোজা কথায় রক ব্যান্ড পছন্দ করি। আমার একটা মাঝারি সাইজের ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল, তাতে জেমস্, বিপ্লব নয়তো হাসানের নতুন কোন গান ফুল ভলিউমে বাজিয়ে শুনতাম। সদ্য মুক্তি পাওয়া সব বাংলা ব্যান্ডের অ্যালবামে ঘর ভরে ফেললাম। স্কুল থেকে ফিরে কোন কোন দিন ক্লান্ত শরীরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে, উপর দিকে দেওয়ালে পা বাধিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ব্যান্ড শুনতাম। মিউজিকের তালে তালে শরীরের প্রতিটা কোষ যেন সাড়া দিত; সে এক পরম তৃপ্তি, গান শুনতে লাগলে কেবলই মনে হত, এর চেয়ে ভাল গান বুঝি আর হয় না।

rabindranath

১৮৭৯ সালে বিলেতে পড়কালীন তরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আমার ছোট ফুপুর এক বান্ধবী প্রায়ই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতো। যথারীতি এক ছুটির দিনে সে এসে হাজির। বিকেলের পড়ন্ত বেলায় সে আমার ঘরে ঢুকলো, যথন আমি বাংলা ব্যান্ড শুনছি। আমি ঝটপট বিছানা ছেড়ে উঠে চেয়ারে বসলাম। ফুপু কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আমার সাথে গান শুনলেন! তবে তার ভাজ হয়ে থাকা চোখের কোন আর কপাল দেখে আমি স্পষ্ট বুঝে গেলাম তার বিরক্তির মাত্রা। যদিও আমার উপর কারো খবরদারি আমি পছন্দ করি না, তবুও বড়দের কিছু কিছু অযাচিত প্রশ্নে বিনয় দেখাতে হয়। কেননা, অভিভাবক হওয়ার সুবাদে কিছুটা খবরদারি করার অধিকার তারা রাখে। আমি এসব গান শুনছি কেন? ফুপুর এমন অযাচিত প্রশ্নে আমি বিব্রত হলাম আর প্রত্যুত্তরে বলার মত কিছুই খুঁজে পেলাম না। ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থাটা কেটে গেলে বিনয়ের সাথে বললাম: কেন, এসব গান ভাল না ?
ভাল! কিন্তু মাথাটা কেমন ধরে আসছে না ?
কই না তো! আমার তো ভালই লাগছে! এর চেয়ে ভাল গান আর হয় ?
তারপর বা-হাতের এক চাপে ফুপু ক্যাসেট প্লেয়ারটা বন্ধ করে আমার দিকে স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, শোন বাবা, তুমি এখন যা শুনছো, তোমার বয়সে এমন পছন্দ খুব বেশি বেমানান না। কিন্তু, আমার কথা শুনে একদিন রবীন্দ্রনাথের গান শুনে দেখবে ? অবশ্য তোমার পছন্দ নাও হতে পারে। তবে তুমি যদি মনে প্রানে একজন সত্যিকারের বাঙালি হয়ে ওঠো, একদিন তুমি রবীন্দ্রনাথের গান ঠিকই শুনবে। তত্ত্বজ্ঞান আর নীতিকথা শেষে সেই বিকেলে ফুপু চলে গেলে ঠোট বাকা করে আমি খানিকটা উপহাসের হাসি হেসেছিলাম। তার বহুবছর পর এখন যখন আমি বুদ হয়ে রবীন্দ্রনাথের গান শুনি; রিনা ফুপুর কথা আমার খুব মনে পড়ে।

ঠিক কবে থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি আকৃষ্ট হই তা দিনক্ষণ মেপে হয়তো বলতে পারব না। তবে যেটা বলতে পারব তা হল; আমার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভাললাগা-মন্দলাগা, সাফল্য- হতাশা, মনবল-মনবিচ্যুতির সবটুকু অনুভূতি ব্যাখা করে, বিশ্বস্ত সহচরের মত সারাক্ষণ সঙ্গ দেয় একমাত্র রবীন্দ্রনাথের গান।
ঠিক যখন শুনি:
‍‍‍‌‌‌‌‌”ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো
তোমার মনেরও মন্দিরে
আমারও পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো
তোমার চরণ মঞ্জিরে “. . . তখন কোথায় যেন হারিয়ে যায়!

“আবার যখন শুনি:
নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুল বনে,
তারি মধু কেন মন মধুপে খাওয়াও না ?
নিত্যসভা বসে তোমার প্রাঙ্গণে
তোমার ভৃত্যের সেই সভায় কেন গাওয়াও না ?” . . . তখন ঈশ্বরকে যেন সামনেই দেখতে পাই।

অথবা, “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি তোমায় . . .”

“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাইনা
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয় না। . . .”

“সখী, ভাবনা কাহারে বলে, সখী, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বল দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’
সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়! . . .” এক অদ্ভুত রকমের ভাললাগা কাজ করে! আবার সব

“ভাললাগা বিলিন হয়, যখন শুনি:
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে–
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে . . .”
তখন কেবলই মনে হয়, আমাকেও একদিন চলে যেতে হবে; শুধু এই লেখাগুলো ছাড়া!

mustafiz

মোস্তাফিজুর রহমান

আমার একান্ত এই অনুভূতিগুলো এভাবে সবাইকে জানিয়ে দিতাম না, যদি কিনা অনুভূতিগুলো আমার একার হতো! পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য রবীন্দ্র অনুরাগীর অনুভূতিও বোধ করি আমার মত; এমনকি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কারো করো ছেলেমানুষী, আহ্লাদ আমার চেয়েও বেশি। বাঙালি হয়ে জন্মে কেউ যদি রবীন্দ্রনাথ না পড়ে, তবে আর যায় হোক সে নিজেকে বাঙালি দাবি করার যোগ্যতা রাখে না। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে আমি কেবলই একজন পাঠক মাত্র; মুগ্ধ, বিস্মিত পাঠক, যে আশ্চর্য হয়ে অনবরত রবীন্দ্রনাথের বাক্যগুলো বোঝার, ধারণ করার চেষ্টা করি। অবশ্য সবক্ষেত্রে তা পেরে উঠি না; রবীন্দ্রনাথ বলেন এক অথচ দর্শনটা রয় অন্য কোনখানে। হয়তো সারা জীবনেও রবীন্দ্রনাথ পড়ে শেষ করতে পারবো না! সত্য বলতে কি, আমি তা করতেও চাই না; রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আমার এই বিস্ময় চিরকাল বাচিয়ে রাখতে চাই!

রবীন্দ্র চিন্তা বরাবরই আমাকে সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন আমি প্রথম রবীন্দ্রনাথ পড়তে শুরু করি। এতটাই মুগ্ধ হই যে, রবীন্দ্রনাথের জাদুকরী বাক্য আমাকে বারবার রবীন্দ্রনাথ পড়তে বাধ্য করে। তাইতো মাধ্যমিকে থাকাকালীন “ছুটি” গল্পটা আমি যতবার পড়েছি, সারা জীবনেও অন্য কোন গল্প ততবার পড়া হয়নি। “ছুটি” গল্পের একটা বাক্য আমাকে পরবর্তি বাক্যের কাছে টেনে নিয়ে যেতো এবং আমাকে বাধ্য করতো প্রতিবার চমৎকৃত হতে। প্রতিবার গল্পটা পড়ার পর “ফটিক” এর দুঃখ আমাকে এতটাই আচ্ছন্ন করতো, যে নিজেকে ফটিকের জায়গায় নিয়ে কল্পনায় খালাসিদের কাছি ফেলে সুর করে জল মাপার মত জপ করতাম।

তারপর যখন গল্পগুচ্ছ হাতে পেলাম, বই খুলে তার মধ্যে নাক ডুবিয়ে প্রথমে গন্ধ নিলাম, যেটা আমি এখনো করি; কয়েক মাস আগে শান্তিনগরের পাঞ্জেরী বুকস্ থেকে চেতন ভগত এর ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান উপন্যাসটা কিনতে গিয়ে প্রথমেই যখন বইয়ের মধ্যে নাক ডুবিয়ে তার গন্ধ নিলাম; আমাকে সাহায্য করতে আসা সেলসম্যান মেয়েটা শব্দ করে হেসে উঠলো। মাসখানেক পর আবার বই কিনতে গেলে সে আমাকে জানালো, সেও এখন নতুন বই হাতে নিয়ে আগে বইয়ের মধ্যে নাক ডুবিয়ে গন্ধ নেয়! প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় প্রতি বছর আমাদের নতুন বই দিত আর আমি বই হাতে পেয়ে প্রথমেই তাতে নাক ডুবিয়ে গন্ধ নিতাম। প্রাইমারি স্কুলটা কবেই ছেড়ে এসেছি, কিন্তু নাক ডুবিয়ে বইয়ের গন্ধ নেওয়ার এই স্বভাবটা ছাড়তে পারিনি; আর কখনো ছাড়তেও চাই না!

তারপর, গল্পগুচ্ছকে দরজা বানিয়ে প্রবেশ করলাম বিশাল রবীন্দ্রজগতে। দৈবভাবে বইটা খুলেই প্রথমে “অপরিচিতা” গল্পটি চোখে পড়লে, আমার মনে হয়েছিল, বিংশ শতকের বিশ্ময়, বাঙালীর শ্রেষ্ট দার্শনিক, কবি রবীন্দ্রনাথের সাথে যথাযথভাবে পরিচিত হতেই দৈবক্রমে এই “অপরিচিতা” গল্পটা বের হয়েছে। পড়তে শুরু করলাম “আজ আমার বয়স সাতাশ মাত্র। এই জীবনটা দৈর্ঘের না হিসাবে বড়, না গুণের হিসাবে। তবু ইহার একটু বিশেষ মূল্য আছে। . . .

আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার নান্দনিক, শৈলীগত, সৃষ্টিশীল বিষয়গুলোর ব্যখ্যা করতে চাই না। সে সাহস, অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। আমি শুধু একজন মুগ্ধ পাঠকের জায়গা থেকে জানাতে চাই, কিভাবে রবীন্দ্রনাথ আমাকে এত আপন করে নিল।

এরপর রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পড়তে শুরু করলে প্রথমে যা আমাকে প্রচন্ড রকম আলোড়িত করলো তা হল “শেষের কবিতা”। এখন পর্যন্ত আমাকে ভাবিয়ে রেখেছে সে গল্প; মানুষের জীবনটা তার ভাবনার মতই কতই না বিচিত্র!

rabindra

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

যে দুজন মানুষ আমাকে প্রতিনিয়ত লেখার জন্য অনুপ্রাণিত করে, প্রলুব্ধ করে; আরও স্পষ্ট করে বললে তাদের লেখার জাদু রীতিমত আমাকে লিখতে বাধ্য করে, তার একজন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস আর অন্যজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যদিও দু-জন পৃথিবীর দুই প্রান্তের, সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি সময়ের, ভিন্ন সংস্কৃতির এবং ভিন্ন রাজনৈতিক পরিমন্ডলের। দুজনই সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন; রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ তে, মার্কেস ১৯৮২ তে। একজনের লেখায় রোমান্টিকতা, আধ্যাত্মিকতা এবং নিরেট বাস্তবতা স্পষ্ট, অন্যজনের রোমান্টিকতা, রহস্য আর জাদুবাস্তবতা।

গাব্রিয়ের গার্সিয়া মার্কেসের “ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ রিভিউ করতে গিয়ে সাহিত্য সমালোচক ফ্রেড ডা’অগিয়ার, গার্ডিয়ান পত্রিকায় যেমন বলেছিলেন: ‘দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের অস্তিত্ব না থাকলে এই উপন্যাস থেকেই তা সৃষ্টি করা সম্ভব হত।’ তেমনি, বাঙালী যদি কখনো তার ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান সম্পুর্ণ হারিয়ে ফেলে, তবে কেবল রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকেই কোন রকম বিকৃতি ছাড়াই তা পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

আমার ঝুল বারান্দায়, একাকি ছাদে, মধ্যরাতে, অলস বিকেলে, সাফল্যে, ব্যর্থতায় সবসময় রবীন্দ্রনাথ আমার সাথে থাকেন, তার জাদুকরী গান, কবিতা আর গদ্যের চমৎকার শব্দমালায়। নেহাতই রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেশি ভালোবাসি বলে এতসব অকেজো কথা লেখা। গল্পের ঢঙে বললেও এগুলো আমার জীবনের সত্য ভাষণ।

(নিবন্ধটি ৮ মে ২০১৩ অর্থাৎ ২৫শে বৈশাখ, ১৪২০, বুধবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২তম জন্মজয়ন্তীতে প্রথম আলো ব্লগে মোস্তাফিজুর রহমনানে নিয়মিত আয়োজন “রবিবারের চিঠি” তে ‘নিয়ম ভাঙা রবিবারের চিঠি’ হিসাবে লেখা। ঠিক তার দুই বছর পর আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪ মত জন্মজয়ন্তীতে লেখক কর্তৃক দু-একটি শব্দ, বাক্য ঘষামাজা করে নিবন্ধটি টাঙ্গাইল বার্তার পাঠকের জন্য আবার প্রকাশিত হল।)

লেখক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

mustafiz120912@gmail.com

ফেসবুক মন্তব্য