হারুন রশিদ, অতিথি লেখক : “মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন, হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয় সেই পথ লক্ষ্য করে, স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে, আমরাও হব বরণীয়” প্রতিটি সমাজে এমন কিছু প্রাত:স্মরণীয় ব্যক্তির জন্ম হয় যাঁদের কাছে ঋণী হয়ে থাকে দেশ ও জাতির অসংখ্য মানুষ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান রাখা মধুপুরের গৌরবদীপ্ত ডঃ অনিমেষ রায় তেমনি একজন মানুষ। স্বীয় মেধা, চেষ্টা, শ্রম ও সাধনার মাধ্যমে মধুপুরের প্রথম ও টাঙ্গাইলের জেলার ডঃ আলীম আল রাজীর পরে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে আজও সকলের শ্রদ্ধার পাত্র তিনি। তাঁর হাত ধরেই আজকের মধুপুরের উচ্চ শিক্ষার প্রসার শুরু হয়েছিল।
ডঃ অনিমেষ রায় মধুপুর রায় পাড়ায় ১৯৪১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত গুপিনাথ রায় এবং মাতা মৃত ননীবালা রায়ের ৮ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম। তিনি ১৯৫৬ সালে মধুপুর রানী ভবানী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাটিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৫৮ সালে টাঙ্গাইল করটিয়া সাদত কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি অল্প কিছুদিন ক্লাস করেছিলেন । অর্থাভাবে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা বাদ দিয়ে তেজগাঁও এগ্রিকালচার কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬১ সালে তেজগাঁও এগ্রিকালচার কলেজ থেকে ব্যাচেলর অফ এগ্রিকালচার (বিএজি) পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাচেলর অফ মাস্টার্স (এমএজি) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে ডঃ অনিমেষ রায় হাওয়াই ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা থেকে “Phosphoras silicon interaction in soils & plants” এর উপর ডক্টরেট (পিএইচডি)ডিগ্রি লাভ করেন।
হাওয়াই রাজ্যের রাজধানী হনুলুলুতে মাটি নিয়ে বিশেষ গবেষণায় সফলতা লাভ করলে, তাঁর কাজের উপর সন্তুষ্ট হয়ে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তাঁকে ১০ ডলার উপহার দিয়েছিলেন।
ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করার পর অনিমেষ রায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটে দীর্ঘদিন প্রিন্সিপাল সাইন্টিফিক অফিসার(সয়েল সাইন্স) কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে কনফারেন্সে প্রায়ই তিনি ফিলিপাইন যেতেন এবং সেই সুবাধে তিনি ফিলিপাইনে ভাল চাকুরী পান এবং একটানা ১০ বছর তিনি সেখানেই কর্মরত থাকেন। চুক্তি শেষে তিনি কিছুদিন ক্যামেরুনেও চাকুরী করেছিলেন। এরপর নতুন চাকুরীর জন্য লন্ডন আসেন। সেখানে তিনি যোগ্যতা অনুসারে চাকুরী না পাওয়ায় দেশে ফেরত আসার কথা ভাবেন এবং দেশেই কিছু করার স্বপ্ন দেখেন।
দেশে ফেরত আসার পথে তিনি কলকাতায় মাইল স্ট্রোক করেন এবং ডাক্তারের পরামর্শক্রমে সেখানেই থেকে যান। ধারাবাহিক চিকিৎসার কারনে তিনি আর বাংলাদেশে না এসে বর্তমানে স্থায়ীভাবে পরিবারের সাথে ইন্ডিয়াতে বসবাস করছেন।
সেই আমলে মধুপুরে প্রথম ও টাঙ্গাইলের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে ডক্টরেট লাভ করায় সবর্ত্র তিনি ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। জনশ্রুতি আছে তিনি যখন পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে প্রথম মধুপুরে আসেন, তাঁর এই বিশাল অর্জনকে সম্মাননা দেখানোর জন্য দূরদূরান্ত থেকে সর্বস্তরের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢাক ঢোল নিয়ে, পায়ে হেঁটে , গরুর গাড়িতে করে এসে তাঁকে অভিনন্দন করেছিল। সেদিন ছিল শিক্ষার জন্য এক বিশাল বিজয় মেলা।
তাঁর লিখিত অনেক জার্নালের মধ্যে Influence of calcium silicate on phosphate solubility & availability in hawaiian latosois অন্যতম। এই জনপ্রিয় জার্নালটি ১৯৭১ সালে নিউ দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয়।
১৯৬৩ সালে ডক্টর অনিমেষ রায় মধুপুর পাকুটিয়ায় অমিয় রায়য়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দুই কন্যা সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে শিল্পী রায় Cambridge university, London থেকে উচ্চতর ডিগ্রি শেষ করে লন্ডন এ বসবাস করেছেন এবং ছোট মেয়ে স্বপ্না রায় Physiotherapy এর উপর উচ্চতর ডিগ্রি শেষ করে ইন্ডিয়াতে বসবাস করেছেন। বহুমাত্রিক কীর্তিতে পরিপূর্ণ ডক্টর অনিমেষ রায় এমনি একজন মানুষ যার পরিধি ও ব্যাপ্তি সুবিস্তৃত ও সুবিশাল। তিনি মধুপুর উচ্চ শিক্ষার প্রথম প্রদীপ। তাঁর জ্বালানো জ্ঞানের প্রদীপ শিখাটি জ্বলুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।