ইমতিয়াজ মেহেদী হাসানঃ একটি সৎ সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন নির্মাতা আবু শাহেদ ইমন। তিনি ব্যর্থ হননি। পেরেছেন। ‘জালালের গল্প’ তারই পরিশ্রমের ফসল। চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার গল্প চলচ্চিত্রটিতে উঠে আসুক। মানুষ জানুক আমাদের সমাজে বরাবরই পার্শ্বচরিত্র হয়ে থাকা জালালদের সমাজপতিরা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, জালাল করে তোলে?
‘জালালের গল্প’ নির্মাতা আবু শাহেদ ইমনের পরিচালনায় প্রথম ছবি। আর প্রথম ছবিতেই করলেন বাজিমাত। পেলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি-পুরষ্কার। সব।
ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত ‘জালালের গল্প’ মূলত জালাল ছেলেটার তিনটা বয়সের গল্প। এই তিন বয়সে বাংলাদেশের তিন ধরণের সামাজিক পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার গল্প চলচ্চিত্রটিতে নিপুণভাবে উঠে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমাজে জালালরা বরাবরই পার্শ্বচরিত্র। আর এই পার্শ্বচরিত্রকে সমাজ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেটাই গল্পের মূল বিষয়বস্তু।
‘জালালের গল্প’ সিনেমার, তিনটি অধ্যায়। পৃথক পৃথক ভাবে প্রতিটি অধ্যায়ই ভয়ংকর সুন্দর। নম্বর বন্টনের দিক দিয়ে বলতে গেলে, প্রতিটি গল্পই দাবী রাখে ১০০ তে ৯০-৯৫ পাওয়ার। কিন্তু নির্মাণশৈলীতার সামান্য ত্রুটি যেন, সে কৃতিত্বকে ‘কিছুটা’ হলেও ম্লান করে দিয়েছে!
যমুনা নদীতে ডেগের ভেতরে ভেসে আসে এক শিশু। স্নানরত অবস্থায় কান্নার আওয়াজ পায় গল্পের মিরাজ তথা নূরে আলম নয়ন। অকস্মাৎ বাচ্চার কান্নার আওয়াজে ঘাবড়ে গিয়ে দৌঁড়ে পালায় সে। পরে গ্রামবাসীদের সহায়তায় ডেগ থেকে উদ্ধার করা হয় শিশুটাকে। এমনকি উপস্থিত সকলের সিদ্ধান্তকর্মে শিশুটাকে দত্তকও দেয়া হয় মিরাজকে। এ’নিয়ে অবশ্য ঘরে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর কাছ থেকে কম বকুনীও শুনতে হয়নি মিরাজকে। যাইহোক, কাকতালীয়ভাবে পরদিন নদীতে রেকর্ড পরিমাণ মাছ ধরা পড়তে থাকে, যা বিগত ৩০ বছরে পড়েনি। এই সূত্র ধরে শিশুটাকে সবাই ‘রহমতের বাচ্চা’ বলে সম্বোধন করতে থাকে। অনেকে ছুটতে শুরু করে রহমতী বাচ্চার দর্শনে, আবার কেউ কেউ পানি পড়া নিতে। এত মানুষের ঢল আর খুশিতে দেয়া তাদের মানতী অর্থে স্বচ্ছলতার মুখ দেখে মিরাজের পরিবার। সুযোটাকে স্থায়ী উপার্জন মাধ্যমে পরিণত করতে, দত্তককৃত সেই শিশু সন্তানকে নিয়ে পানি পড়ার ব্যবসা ফাঁদেন লোভান্ধ মিরাজ। এমনকি ব্যবসা পরিচিতির লক্ষ্যে শিশু সন্তানটির একটি নামও ঠিক করা হয়। নাম রাখা হয় জালাল। স্বার্থের গ্যাঁড়াকলে অবশ্য মিরাজের সেই রমরমা ব্যবসা বেশিদিন টেকে না। গ্রাম্য শালিসের সিদ্ধানুযায়ী বাধ্য হয়ে আবারও সেই শিশুকে ডেগে ভরে, ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীতে।
প্রথমার্ধের এই গল্পে নদীপাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা আর চিরায়ত কুসংস্কারের এক অপূর্ব অবয়ব ফুটে উঠেছে। তবে, এই অংশে শিশু জালালের দত্তক পিতা-মাতার চরিত্র রূপদানকারী নূরে আলম নয়ন আর মিতালি দাশের অভিনয় আদৌ কোন ‘দক্ষ’ অভিনয় প্রশংসার দাবী রাখেন কিনা, তা কেবল দর্শক-বোদ্ধারাই বলতে পারবেন!
৮ বছর বয়সী জালাল ঠাঁই পেয়েছে, গ্রামের সবথেকে প্রভাবশালী মানুষটার ঘরে। যে কিনা আঁটকুড়ে। পরপর দু’বার বিবাহ করলেও, স্ত্রীরা তাকে কোন সন্তান দিতে পারেন নি। বংশরক্ষার পাশাপাশি আসন্ন চেয়ারম্যানি নির্বাচনে নিজের পরাজয়ের কথা মাথায় রেখে, ঘরে তৃতীয় স্ত্রী আনেন তিনি। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি দেখে, বাধ্য হয়ে কবিরাজের দ্বারস্থ হন। এখানেও যেন হতাশার সুর বাজে, ইউফোনিয়ামে। কতরকম তন্ত্র-মন্ত্র শেষে অবশেষে হাঁসপড়া। তবুও কাজ হয় না। সন্তান আসার কোন লক্ষণই দেখা যায় না। সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে চতুর কবিরাজ চিকিৎসার নামে চেয়ারম্যান যশপ্রার্থী তৌকিরের তৃতীয় স্ত্রীর রূপদানকারী শর্মীমালার সাথে মাততে থাকে যৌনতায়। জানালার ফাঁক দিয়ে সেসব দৃশ্য প্রায়ই দেখা ফেলত শিশু জালাল। একদিন হাতেনাতে ধরা খেয়ে, তার কপালে জোটে ‘কুফা’র বদনাম। সে বাড়ি থেকে না সরলে নাকি শর্মীমালার গর্ভে সন্তানই আসবে না! চেয়ারম্যান হওয়ার নিখাঁদ লোভে কবিরাজের প্ররোচনায়, বস্তাবন্দী করে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয় জালালকে লখীন্দরের বেশে। তবে মৃত নয়, জীবিতবেশেই।
দ্বিতীয়ার্ধের এই গল্পে জালাল চরিত্রে রূপদানকারী ইমন আর শর্মীমালার প্রশংসনীয় অভিনয়শৈলিতা থাকলেও রয়ে গেছে বেশ ক’টি ত্রুটি। গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ৬/৭ মাস আগে মিছিল আর তৌকির আহমেদের মঞ্চ ঘরানায় সংলাপ বলাটা সিনেমার জন্য বোধকরি শুভ হয়নি। বরং চিত্রনাট্যের ‘স্বাভাবিকতা’ নষ্ট করেছে। তবে হ্যাঁ, গল্পের এ’পর্বের দৃশ্যায়ন আর শিল্পনির্দেশনা নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সিনেমার সাথে বাংলাদেশের সিনেমাকেও প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখে। আর কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয়ার মুহুর্তে জালালের হৃদয়স্পর্শী আর্তনাদ, দর্শকদের কাঁদাবে এ’কথাও বলার অপেক্ষা রাখেনা।
সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় সবই। তাই সেটা হোক কম আর বেশি। এ’তালিকা বাদ যায় না, জীবন-চিন্তাধারা-পথচলা কোনকিছুই। জালাল এখন আর ছোট্টটি নেই। সে এখন ১৮/২০ বছর বয়সী এক তরুণ। ঠাঁই পেয়ে বাস করছে সবুজ গ্রামীণ পরিবেশ থেকে কিছুটা দূরে, শহুরে পরিবেশে। আর ‘চরিত্রহীন’ চরিত্রে রূপদানকারী চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মোশাররফ করিম এবার তার পিতা। যে কিনা যাত্রাদল থেকে তুলে আনা তরুণী শিলা তথা মৌসুমী হামিদকে তার ‘তথাকথিত’ পুরানো প্রেমিকা স্বর্ণার কথা বলে তাকে ‘ইমোশনালী উইক’ করে ভোগ্যবস্তুতে পরিণত করে। একটা সময় শিলা অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়ে। বিষয়টি মোশাররফ করিমকে জানালে, সে বাচ্চাটাকে নষ্ট করার কথা বলে। কিন্তু কোনমতেই বাচ্চা নষ্ট করতে নারাজ শিলা। ওদিকে নির্বাচনের দিনক্ষণও সন্নিকটে। অগত্যা জালালের ঘাড়েই দেয়া হল শিলার ভার। জালালও শিলার ভার নিতে অসম্মতি জানালো না। দিন এগুতে থাকলো। জালাল-শিলাদের বন্ধুত্বপূর্ণ জীবনের পাশাপাশি চলতে থাকলো ওদিকে, মোশাররফ করিমের কৌশলী নির্বাচনী প্রচারণায়ও। একদিন সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে, মৃত্যু হল শিলার। শিলার রেখে যাওয়া সন্তান নির্বাচনে বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে, এমনটি ভেবে বহু বছর আগে জালালের ভেসে আসা ডেগে ভাসিয়ে দেয়া হয় শিশুটিকে। আর তাকে বাঁচাতেই গিয়েই প্রাণ হারায় পানিতে ভেসে আসা, সাঁতার না জানা জালাল।
শেষার্ধের এই গল্পে জালালকে মোশাররফ করিমের বাস্তব চেনানোর দৃশ্যটা হয়তো দর্শক অনেকদিন মনে রাখবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, প্রচলিত নাটকী ঘরানার সংলাপ ভঙ্গিমা থেকে কি বেরোতে পেরেছেন মোশাররফ করিম? হ্যাঁ, তিনি ‘জালালের গল্প’ চলচ্চিত্রে ‘চরিত্রহীন’ চরিত্রে অভিনয় করে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ‘সেরা’ অভিনেতার পুরষ্কার জিতেছেন। দেশকে বিশ্বদরবারে আরও একবার নতুনকরে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এজন্য তাঁকে অভিনন্দন। সাধুবাদ। তবে আমরা কি তাঁর থেকে আরও ‘মেধাবী’ অভিনয় প্রত্যাশা করতে পারতাম না? আমার কাছে মনে হয় মোশাররফ করিমের এহেন প্রচলিত বাচনভঙ্গি ‘জালালের গল্প’র অন্যতম দুর্বল দিক। তবে এ’পর্বের গল্পে মৌসুমী হামিদ (শিলা) আর আরাফাত হোসেন (জালাল)-এর ‘আউনস্ট্যান্ডিং’ অভিনয় দর্শককে মোহিত করবে।
বিদেশী সিনেমা নকল নয়, বরং দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বভাষা আর নির্মাণশৈলিতাই অত্র চলচ্চিত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে। পরিলক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার গল্প। ডেগে ভেসে আসা জালালের সমাজে পার্শ্বচরিত্র হয়ে থাকার গল্প পুরো সিনেমা জুড়েই ফুটে উঠেছে, যা সমাজ কর্তাদের সমাজপতি বানিয়েছে ঠিকই। কিন্তু প্রকৃত মানুষ করেনি।
প্রচলিত ধাঁচের না হলেও, চিত্রনাট্য অনেক সমৃদ্ধ আর গোছালো। এজন্যই বোধকরি বড় ধরণের কোন গোঁজামিল চোখে পড়েনি। আর নির্মাতার নির্মাণে একান্ত নিজস্বতা ছিল চোখে পড়ার মত, যেটা কিনা সিনেমা দেখে সামগ্রিক অর্থেই বলা যায়। বলতে বাধ্য করে। আর সিনেমাটোগ্রাফার বরকত হোসেন পলাশের কথা তো না বললেই নয়। হ্যাটস অফ। বাদ যায় না চিরকূটের করা ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরও। অসাধারণ।
ঢাকাই সিনেমা মানেই নাচ-গান-প্রেম নয়, এর বাইরেও ভিন্ন কিছু হতে পারে। ভিনদেশী সিনেমার গল্প কিংবা চিত্রনাট্য হুবহু অনুকরণ কিংবা নকল না করেও, পরিমিত বাজেটে বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার গল্প নিয়েও ‘রুচিশীল’ চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব, যেটা যেন সবার চোখে বেশ আঙুল দিয়েই দেখালেন নির্মাতা আবু শাহেদ ইমন! আর সবচেয়ে বড় কথা-কোন কিছুই অতিরঞ্জিত নয়। বরং পরিমার্জিত আর সাজানো-গোছানো।
সিনেমাটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করা নবাগত আরাফাত রহমান ও মোহাম্মদ ইমন কেবল জালালের ভূমিকায় অভিনয়ই করেননি, বরং পার্শ্বচরিত্র হয়ে থাকা সমাজের সকল জালালদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ফুটিয়ে তুলেছেন অভিনয়শৈলিতার মাধ্যমে জালাল সম্প্রদায়কে। পাশাপাশি মুখোশ উন্মোচন করেছেন তথাকথিত ওই ‘সমাজপতি’দের।
রুপালী পর্দায় ইমন নির্মাতা হিসেবে নতুন হলেও, লোকেশন নির্বাচনে রেখেছেন রুচিশীলতার পরিচয়। কৃতিত্বের পরিচয়। চিত্রনাট্য অনুযায়ী টাঙ্গাইল ও জামালপুরের বিভিন্ন লোকেশনে দৃশ্যায়িত এ’চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন, শব্দ ধারণ, পোশাক সজ্জা, সেট ডিজাইন, কালার গ্রেডিং, চরিত্রায়ন সর্বোপরি ঠিক থাকলেও সামান্য ত্রুটি রয়ে গেছে যেন সম্পাদনায়। সম্পাদনা অবশ্য আরেকটু ভালো হতে পারতো। যেটা চলচ্চিত্রটাকে আরও সমৃদ্ধ করতো।
তবে হ্যাঁ, গল্প বলায় নতুনত্ব রেখে বিশেষত্ব রেখেছেন নির্মাতা সংলাপে, যেটা মানতেই হবে। এই ধরুন ‘মিথ্যা বলা পাপ আর সত্য বলা মহাপাপ’, ‘বাস্তব শক্ত, নরম নয়’, ‘এই হাঁসের মাংশ খেলে শুধু মহিলা নয়, পুরুষও পোয়াতী হইয়া যাইব’ প্রভৃতি।
প্রচলিত ধাঁচের নাচ-গান বিহীন সিনেমাও ‘ভালো’ সিনেমা হতে পারে, মানুষের নজর কাড়তে পারে। এমনকি পরিমিত বাজেটে দেশীয় কলাকুশলী নিয়ে দেশের লাল-সবুজের পবিত্র মানচিত্রে ‘দারুণ’ সিনেমা নির্মাণ এখন আর অসম্ভব নয়, সেটা আবু শাহেদ ইমন খুব সাবলীলভাবেই ‘জালালের গল্প’ দিয়ে জানিয়ে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের দিন ফিরতে শুরু করেছে, অনায়স আস্বাদনের চলচ্চিত্র না হয়েও ‘জালালের গল্প’ যেন তেমনই বার্তা শোনাচ্ছে।
জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের, জয় হোক ‘জালালের গল্প’র।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী