মোঃ হারুন অর রশিদ, অতিথি লেখক : মধুপুরবাসি ফেইসবুক গ্রুপের মাধ্যমে আমরা মধুপুরের স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছি। ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় আমরা উৎসাহিতবোধ করছি। আজ ধারাবাহিকতা স্বরূপ আমরা মধুপুরের প্রথম মহিলা হিসাবে যিনি ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেছেন অর্থাৎ ডঃ সাঈদা আখতার বেগমের সংক্ষিপ্ত জীবনী আপনাদের মাঝে তুলে ধরছি।
আজ থেকে ১৪০ বছর আগে নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তৎকালীন সমাজে পশ্চাৎপদ নারীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াসে যে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন তাঁর দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় আজকে বাংলাদেশের নারীরা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছেন। ডঃ সাঈদা আখতার বেগম ঠিক তেমনি একজন অগ্রসর নারী। তৎকালীন মধুপুরে পশ্চাৎপদ নারীদের মাঝে থেকেও তিনি মায়ের উৎসাহে ও নিজের চেষ্টায় মধুপুরের প্রথম মহিলা হিসাবে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণকারী মধুপুর টেংরি গ্রামের ডঃ সাঈদা আখতার বেগম ৪ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট। বাবা মৌলভী মনিরুউদ্দিন আহমেদ শিক্ষক প্রশিক্ষক ইন্সটিটিউটে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মা আমেদা খাতুন একজন সুগৃহিণী।
খুব কম বয়সেই বড় বোনের বিবাহের পর স্বামীর বাড়ী থেকে নানা ধরনের অবহেলা ও অত্যাচার দেখে তাঁর মা সিধান্ত নেন যে ছোট মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত না করে বিবাহ দেবেন না। তাই মধুপুর ফ্রি প্রাইমারী স্কুল থেকে ১৯৬১ সালে প্রাইমারী শিক্ষা শেষ করার পর টাংগাইল বিন্দুবাসিনী সরকারী বালিকাতে ভর্তি করে দেন তাঁর মা। পড়াশুনা করার জন্য ভাড়াকৃত বাড়িতে বড় ভাইয়ের সাথে থেকেই তিনি ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি কুমুদিনী সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন এবং
১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণে প্রথমবর্ষে ভর্তি হন। পরবর্তীতে দেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কারনে তিনি সময়মতো (অনুষ্ঠিত হয়নি)বিএ অনার্স পাস না করলেও ১৯৭৩-৭৪ সালে সমাজ কল্যাণে বিএ অনার্স সমাপ্ত করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ কল্যাণে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স অধ্যায়নরত অবস্থায় তিনি সমাজ কল্যাণ গবেষণা ইন্সটিটিউটে সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদিকা ছিলেন।
মাস্টার্স পাসের পর মহাখালী কলেরা হাসপাতালে গবেষক হিসাবে তিনি প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে তেজগাঁও কলেজে প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক হিসেবে সমাজ কল্যাণ বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও ব্যক্তিগত কারনে তিনি তেজগাঁও কলেজেই থেকে যান। ১৯৮৫ সালে তিনি চিকিৎসা সমাজকর্মী হিসেবে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়োগ পেয়েও যোগদান করেননি। তিনি তেজগাঁও কলেজে সমাজ কল্যাণ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন।
ডঃ সাঈদা আখতার বেগম ২০০০ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম ফিল ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “ঢাকা শহরের বস্তির মহিলা ও উন্নয়ন সমীক্ষা”।
২০০৮ খ্রি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল “ঢাকা শহরের মহিলা শ্রমিকদের আর্থ সামাজিক অবস্থা এবং সামাজিক মর্যাদা” ।
তিনি সমাজকর্মী হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবত জড়িত আছেন । এখানে উল্লেখ্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের গোপন কর্মসূচি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তদানে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ছাত্র অবস্থায় ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ইন্সটিটিউটে অবৈতনিক নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনে অগ্রনি ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়া তিনি শেরে বাংলা নগরের মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সংস্কারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ২০০৮ সালে এইচআইভি / এইডস প্রতিরোধে প্রতিরোধে PIACT নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাস্টার্স ট্রেইনার হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
ডঃ সাঈদা আখতার বেগম ১৯৭৮সালে টাঙ্গাইল সদর থানার পিচুরিয়া গ্রামের মোঃ হযরত আলী সাহেবের দ্বিতীয় পুত্র মোঃ মিজানুর রহমানের সঙ্গে পরিণয় সুত্রে আবদ্ধ হন।
তিনি ডেনমার্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেলো ডিগ্রি লাভ করে বর্তমানে ঢাকা মহাখালী উদরাময় হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রফফেসর ডঃ সাইদা আখতার বেগম দুই পুত্র সন্তানের জননী। প্রথম পুত্র মোঃ সায়মুর রহমান একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিআর ও এম বি এ। বর্তমানে তিনি একটি মাল্টিনেশন সংস্থায় চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ছোট ছেলে মোঃ ফান্তাসির রহমান আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ শেষ করে সদ্য মালেশিয়ার SEGI UNIVERSITY থেকে এমবিএ সমাপ্ত করে আসলেন।
ডঃ সাইদা আখতার বেগম দীর্ঘ ৩৫ বছর যাবত অত্যন্ত কৃতিত্তের সাথে তেজগাঁও কলেজে অধ্যাপনা করেছেন । তিনি দুইবার অত্র কলেজের গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছাত্র ছাত্রীদের নিকট অত্যন্ত নিষ্ঠাবান শিক্ষকনেত্রি হিসেবে সুপরিচিত।
বর্তমানে তিনি ঢাকায় মিরপুর এ নিজস্ব বাসভবনে অবসর জীবন যাপন করলেও নারী জাগরণ, নারী স্বাধীনতা ও নারী শিক্ষা বিষয়ে পূর্বের মতো পত্র-পত্রিকায় লিখে যাবেন। এছাড়া নারীদের নিয়ে কিছু বই বের করারও পরিকল্পনা আছে তাঁর। অবসর নিয়েছেন মাত্র কিছুদিন হল। এরই মধ্যে তিনি নারী শ্রমিক ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন তৈরি করেছেন। এই সংস্থার চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি মধুপুরের নারীদের আত্ম সামাজিক তথ্য সংগ্রহ করবেন বলে জানালেন।
ডঃ সাঈদা আখতার বেগম সফল গবেষক, শিক্ষক, নারী সংগঠক ও সমাজসেবী হিসেবে ব্যক্তিত্বের অধিকারী। জেন্ডার সমতা বিষয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি বর্তমান সময়ের অবহেলিত নির্যাতিত নারী মুক্তির অগ্রদূত। তিনি আমাদের মধুপুরের গর্ব ও অহংকার।
লেখক : জাপান প্রবাসী মধুপুরের কৃতি সন্তান। প্রতিষ্ঠাতা : অনলাইনভিত্তিক সামাজিক সংগঠন, মধুপুরবাসী ফেসবুক গ্রুপ।