ডেস্ক রিপোর্ট : দেশে ফিরলেই দুর্নীতির ‘মহারাজা’ হিসেবে পরিচিত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে মুখোমুখি হতে হবে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের। বিগত মহাজোট সরকারের সময় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় একের পর এক দুর্নীতির মাধ্যমে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারের সম্পদ পানির দরে বিক্রি করেছিলেন এই মন্ত্রী। সরকারি সম্পত্তি পানির দরে বিক্রি করলেও নিজে হয়েছেন বিত্ত-বৈভবের মালিক।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে তার দুর্নীতি তদন্তে গঠিত কমিটির তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে তার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিভিন্ন খতিয়ান। ইতিমধ্যে কমিটি মন্ত্রীর পাহাড়সমান দুর্নীতির প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে। যাতে লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতির প্রায় অর্ধশত প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে।প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তদন্তে বের হওয়া দুর্নীতির এসব অভিযোগের জন্য বর্তমান সরকারের ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে এসব অভিযোগের বিষয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুদক। এর বাইরে এখন তিনি যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন সেখানেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়েও তাকে দুদকের মুখোমুখি হতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতি ও প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে মন্ত্রী থাকাবস্থায় আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে যে সমস্ত অনিয়মের তথ্য উঠে আসছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয় বেরিয়ে এসেছে বলে আমরা জানতে পারছি, তা থেকে এটা বলা যায়, তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ যথার্থ। এই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই সাজা দিতে হবে। তার বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ হবে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হবে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা। এ ছাড়া ইতিমধ্যে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দুদকও তার বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে পারে। ক্ষমতার দাপটে বিগত মহাজোট সরকারের সময়ে সরকারি নিয়ম-কানুন কোনো কিছুই কেয়ার করতেন না তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিজের একক সিদ্ধান্তে মহাজোট সরকারের গত পাঁচ বছর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় চালিয়েছিলেন তিনি। তার ভয়ে সচিব থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন তটস্থ ও অসহায়। সরকারি নিয়ম-কানুন কিংবা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো কথাই মন্ত্রী আমলে নিতেন না। এভাবেই নিজের একক সিদ্ধান্তে তিনি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী থাকাবস্থায় বিনা টেন্ডারে সরকারের সম্পত্তি বিক্রি, ইজারা দেওয়া, কিংবা হস্তান্তর করেছেন। যাতে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। মন্ত্রীর নির্দেশমতো তড়িঘড়ি করে কাজ করতে বাধ্য ছিলেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি করতে গিয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এমনও বলেছেন, ‘নীতিমালা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ কর।’ বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী থাকাকালে লতিফ সিদ্দিকী রাজধানীর ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন মতিঝিল মৌজার হোল্ডিং নং ১৭৬, আর এস দাগ নং ২৪৫৮, ঢাকা সিটি জরিপের দাগ নং- ৩৩৩৯ এর অন্তর্ভুক্ত ১১ কাঠা ১৩ ছটাক জমি নামমাত্র মূল্যে (এক কোটি এক লাখ এক হাজার একশত টাকা) দিয়েছেন চট্টগ্রাম সমিতিকে। কারণ তার স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী হচ্ছে চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতি। ওই জমি দেওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রী নোট শিটে লিখেছেন, ‘ব্যক্তিগত জীবনে আমি চট্টলা কন্যার পাণি গ্রহণ করেছি। মানবতার সেবায় তাদের সহযোগিতা করার নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে এটা করছি।’ শুধু তাই নয়, এভাবেই একে একে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহার করে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে লতিফ সিদ্দিকী সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্তত ৪৮টি বেসরকারি সম্পত্তি বিক্রি, ইজারা ও হস্তান্তর করেছেন।এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানেও লতিফ সিদ্দিকীর অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে যে তদন্ত প্রতিবেদন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে তাতে লতিফ সিদ্দিকীর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বর্ণনা দিয়ে ৪৮টি সম্পত্তির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছে। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সম্পূর্ণ নিয়ম-বহির্ভূতভাবে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ও বিনামূল্যে বা কমমূল্যে যেসব সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়েছে, সেগুলো আবার সরকারের অনুকূলে ফেরত নেওয়ার বিষয়টি যাচাই করে দেখতে হবে। এ ছাড়া কমিটি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিনামূল্যে বিক্রি, হস্তান্তর ও ইজারা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বিটিএমসি, তাঁত বোর্ড, বিলুপ্ত জুট করপোরেশন (বিজেসি) এবং বিজেএমসির মোট ৪৮টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ ও হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে বিনা টেন্ডারে দেওয়া হয়েছে ১২টি। ৪৮টির মধ্যে ৩০টি প্রতিষ্ঠান পূর্ণাঙ্গ হস্তান্তর করা হয়েছে। ১৭টি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াধীন।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ রয়েছে, নয়-ছয় করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে গাজীপুরের বিখ্যাত মসলিন কটন মিল। ২০১১ সালে রিফাত গার্মেন্ট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র ১৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয় এটি। যা সম্পূর্ণ বেআইনি। এটি হস্তান্তর করা হয়েছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এবং এর দায়-দেনা ও মূল্য যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী কুমিল্লার দৌলতপুরের চিশতী টেক্সটাইল মিলস বিনা টেন্ডারে ও কমমূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। একইভাবে খুলনার দৌলতপুরে অবস্থিত বিজেসির সম্পত্তি পাট বেলিং কেন্দ্রটি বিক্রি হয়েছে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর নিদের্শ অনুযায়ী ওই কেন্দ্রটি মাত্র পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। অথচ এটি বন্ধ হওয়ার পর ২০০৯ সালে এই সম্পত্তিটি দাম ধরা হয় ১৪ কোটি ৪২ হাজার ২১৩ টাকা। কমিটি প্রতিবেদন অনুযায়ী শ্রমিক ও কর্মচারীদের কাছে হস্তান্তর করা চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের ফ্যারিলিন সিল্ক মিলস নীতিমালা ভেঙে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে অবস্থিত নিউ লক্ষ্মী কটন মিলটি চুক্তি ও নীতিমালা বহির্ভূতভাবে তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একইভাবে বিনা টেন্ডারেই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে নেত্রকোনার সাবেক জুট বোর্ড ও বগুড়ার সুরজমহল আগরওয়ালা মিলটি। কুড়িগ্রামের ঘেঊরচাঁদ মাঙ্গিলাল জমিটি নিষ্কণ্টক না করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের ন্যাশনাল কটন মিল বিক্রির আগে মতামত নেওয়া হয়নি অর্থনৈতিক মন্ত্রিসভা কমিটির। বিনামূল্যে হস্তান্তর করা হয়েছে রাজধানীর হাটখোলার ঢাকেশ্বরী কটন মিলটি। কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে নাসিরাবাদের ভ্যালিকা উলেন মিল কম। এ ছাড়া জামালপুরের আর সিম প্রেস হাউস বিক্রির ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। একইভাবে বেসরকারিকরণ কমিশন আইন ও নীতিমালা মানা ফেনীর রানীর হাটের দোস্ত টেক্সটাইল হস্তান্তরের ক্ষেত্রে।সম্প্রতি নিউইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পবিত্র হজ ও তাবলীগ জামাতসহ নানা বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এরপরই বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
সৌজন্যে : দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন