আহমদ ছফা বাংলাসাহিত্যে যিনি প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছেন। তাঁর ব্যক্তি চিন্তা ও মননের সাথে ব্যক্তি জীবনের স্ববিরোধ ছিল না। সাধারণের মতো জোয়ারে গা ভাসানোয় তিনি তীব্র বিরোধী ছিলেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বোধ বুদ্ধি বিবেচনা ও জীবনাভ্যাসকে তীব্র সমালোচনা করেছেন আজীবন। তিনি ষাট সত্তর দশকের বাঙালী মুসলমানদের সংগ্রামী ও রাজনৈতিক অংশীদারিত্বকে সমর্থন করলেও স্বাধীনতাত্তোর গুটিয়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদকে চরম সমালোচনা করেছেন। ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ নামে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থও তাঁর প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৮১ সালে। বুদ্ধিচর্চার জগতে এটি খুবই আলোচিত একটি বই। যাতে তিনি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে মধ্যবিত্ত সমাজের পশ্চাৎপদতার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করেছেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, অনুবাদ, কলাম লেখা, ইতিহাস ও ভ্রমণ কাহিনীসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন। আহমদ ছফার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ উপন্যাস- সূর্য তুমি সাথী। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ত্রিশেরও বেশি। তাঁর উল্লেখ যোগ্য বই গুলো হলো প্রবন্ধ- জাগ্রত বাংলাদেশ (১৯৭১), বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১), নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ (১৯৯৫), সঙ্কটের নানা চেহারা (১৯৯৬), বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র (২০০১), কবিতা-জল্লাদ সময় (১৯৭৫), দুঃখের দিনের দোহা (১৯৭৫), একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা (১৯৭৭), লেনিন ঘুমোবে এবার (১৯৯৯)।উপন্যাস- সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭), ওংকার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮), গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬) প্রভৃতি।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে তিনি জন্মেচ্ছিলেন। তাঁর পিতা মরহুম হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া। মা মরহুমা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। ছাত্রাবস্থায় তিনি কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন।
১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে বাংলা বিভাগে পাঠ সম্পন্ন করেননি। ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭১ সালে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যোটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন।
তিনি লেখক শিবির পুরস্কার লাভ করেন ও বাংলা একাডেমি কর্তৃক সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার পান। তাঁকে ২০০২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে (মরণোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয় ।
২০০১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। শারীরিক বিলুপ্তি ঘটলেও তাঁর সৃজনশীলতার আলোয় আলোকিত হবে আগামী বাংলাদেশ- এটাই আমাদের বিশ্বাস।