গণভোট: সংসদ নির্বাচনের আগে নাকি পরে হয়েছিল

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত: শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫
গণভোট: সংসদ নির্বাচনের আগে নাকি পরে হয়েছিল

প্রধান উপদেষ্টার কাছে ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়া জমা দেওয়ার পর থেকেই রাজনীতিতে গণভোট আয়োজনের সময় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কমিশন সুপারিশ করেছে, আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন অথবা এর আগে উপযুক্ত সময়ে গণভোট হবে।

বিএনপি জানিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ছাড়া গণভোটের সিদ্ধান্ত তারা মানবে না। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি দল নভেম্বরের মধ্যে জুলাই সনদের ওপর গণভোট আয়োজনের দাবি জানিয়েছে। আর অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, গণভোটের সময়ের ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প নিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

আগের তিনটি কখন হয়েছিল
১৯৭৭ সালে প্রথম গণভোটটি হয়েছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে। মিজানুর রহমান চৌধুরীর ‘রাজনীতির তিন কাল’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছরের ২২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করে ৩০ মে গণভোটের ঘোষণা দেন। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লক্ষ্যে সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের সংশোধন করেন। গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য ২ মে সামরিক আইন আদেশ জারি করেন।

১৯৭৭ ও ১৯৮৫ সালের গণভোটের খবর নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন। ছবি: মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ

১৯৭৭ ও ১৯৮৫ সালের গণভোটের খবর নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন। ছবি: মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ

দ্বিতীয় গণভোট হয় ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। ক্ষমতায় তখন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। মিজানুর রহমান লিখেছেন, এই গণভোটের আগে পয়লা মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এরশাদ। তিনি সব নির্বাচন বাতিল ও রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও সামরিক আদালত পুনর্বহাল করে নিজে প্রেসিডেন্ট পদে থাকবেন কি থাকবেন না এ প্রশ্নে ২১ মার্চ গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এরপর ১৫ দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও ৭ দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে অন্তরীণ করা হয় এবং ২ মার্চ সংসদ নির্বাচনের তপসিল বাতিল ঘোষণা করা হয়।

ক্ষমতায় বিএনপি ও গণভোট
তৃতীয় গণভোট হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। এটি ছিল পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় সাড়ে ৬ মাস পরে। ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচন হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। তখন অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে থাকা দলগুলো পৃথক জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ আট, বিএনপি সাত ও বামপন্থীরা ছিল পাঁচ দলীয় জোট। নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়। ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন খালেদা জিয়া।

১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময়ও দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা ছিল। ১৯৭৫ সালে এই পদ্ধতি চালুর লক্ষ্যে সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘রাজনীতির তিন কাল’ বইয়ে লেখা হয়েছে, ’৯১ সালের নির্বাচনের পর সংসদীয় পদ্ধতিতে যাওয়া নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়। কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্ত না আসায় দেশে এক নতুন বিতর্ক শুরু হয়। পরে ১ জুলাই জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ অপরদিকে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে বিএনপি সরকার পদ্ধতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

রাষ্ট্রপতি থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় যাওয়ার বিল পাস হয় ১৯৯১ সালের আগস্টে। ছবি: মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ

রাষ্ট্রপতি থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় যাওয়ার বিল পাস হয় ১৯৯১ সালের আগস্টে। ছবি: মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ

১৯৯১ সালে আগস্টে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার একাধিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৬ আগস্ট সংসদে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল পাস হয়। ৭ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে খালেদা জিয়া বলেন, অচিরেই গণভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত রায় পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদ্ধতি প্রবর্তিত হবে। ১২ আগস্ট টেলিভিন ও রেডিওতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রউফ ঘোষণা করেন, ১৫ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিলের প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদে গৃহীত এই বিলে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী গণভোট আয়োজন করা হবে।’

১৯৯১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দ্য বাংলাদেশ অবজারভার এর প্রতিবেদনে বলা হয়- সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে সারা দেশে মানুষ ব্যাপক উৎসহ উদ্দীপনা নিয়ে ভোট দিয়েছেন। কেবল রংপুরে সবচেয়ে বেশি ‘না’ ভোট পড়ে। ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৮টি ‘হ্যাঁ’ ভোটের বিপরীতে ‘না’ ছিল ২ লাখ ৫৩ হাজার ৫৫৭টি।

সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধান উপদেষ্টা
বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর এক ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কিংবা গণভোট নিয়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। আমরা তাঁকে সহায়তা করার জন্য থাকব। সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট কেউ নেবেন না, এটা আপনারা নিশ্চিত থাকেন। এই সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টা নেবেন। আমাদের সঙ্গে পরামর্শের প্রয়োজন হলে তিনি করবেন। আমরা যে সিদ্ধান্ত নেব, সেখানে দৃঢ় থাকব। আর সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত নেওয়া হবে।

সংবাদটি দৈনিক সমকালওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। তথ্যের সঠিকতা ও মালিকানা বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে অনুগ্রহ করে মূল সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।