হেমনগর জমিদার বাড়ি আজ কালের সাক্ষী
পরীর দালান নামে সর্বাধিক পরিচিত হেমনগর জমিদার বাড়িটি দর্শনীয় স্থাপনা। এটি টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার শিমলাপাড়া মৌজায় বর্তমানে হেমনগর অবস্থিত। ভবনের ছাদে দু’টি পরীর ভাস্কর্যসহ অনেক কারুকার্যময় পুরোনো স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন বিখ্যাত এই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে ক্রমাগত ক্ষয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, তৎকালীন ব্যবসায়ী কালীচন্দ্র চৌধুরী সূর্যাস্ত আইনের আওতায় শিমুলা পরগনা জমিদারি ক্রয় করে জমিদারী পরিচালনা করেন। তিনি তদানিন্তন ময়মনসিংহ জেলার মধুপুর থানার অন্তর্গত আম্বারিয়া এ্যাস্টেটের জমিদার ছিলেন। পরবর্তীতে তার একমাত্র পুত্র হেমচন্দ্র চৌধুরী জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব পান। তিনি আমবাড়িয়া স্টেটে বাড়ি নির্মাণ করে জমিদারী পরিচালনা শুরু করেন। কিন্তু আমবাড়িয়া থেকে যমুনার পূর্বপাড় হয়ে মধুপুর গড় পর্যন্ত বিস্তৃত শিমুলার পরগণার বিশাল জমিদারী পরিচালনা দূরূহ হয়ে উঠে। তাই তিনি ১৮৮০ সালে মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়া রাজবাড়ি ত্যাগ করে গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের সুবর্ণখালি গ্রামে নতুন রাজবাড়ি নির্মাণ করেন এবং সেখান থেকেই জমিদারি পরিচালনা শুরু করেন। সুবর্ণখালি ছিল যমুনা তীরের প্রসিদ্ধ নদীবন্দর। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দশকে যমুনার করাল গ্রাসে বিলীন হয় সুবর্ণখালি নদীবন্দর ও হেমচন্দ্রের রাজবাড়ি।
তারপর জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৮৯০ সালে শিমলাপাড়া মৌজায় নতুন একটি দ্বিতল রাজপ্রাসাদ বিশিষ্ট এই বাড়িটি নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। সে সময় তিনি নিজের নামে শিমলা পাড়ার নামকরণ করেন ‘হেমনগর’। বাড়িটি পরিচিতি পায় হেমনগর জমিদার বাড়ি নামে।
উঁচু ও প্রশস্ত দেওয়ালে ঘেরা বাড়ির ভেতরে সুপেয় পানির জন্য একাধিক কূপ খনন করা হয়েছিল। সেখানে ছিল চিড়িয়াখানা, পূজামণ্ডপ, হাতিশালা ও ফুলের বাগান। পরীর দালানের সামনেই ছিল দ্বিতল নাটঘর। বাড়িটির ভেতরে ও সামনে রয়েছে ইট ও সুরকি দিয়ে পাকা সান বাঁধানো ঘাটসহ বিশাল দিঘি। দালানের আশেপাশেও স্বজনদের জন্য সান বাঁধা ঘাটসহ দিঘি ও পাকা বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছিল।
ভবনের দেয়াল, পিলার, ফটকে রঙ্গিন কাঁচ ব্যবহার করে ফুল, তারা, গাছ ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে। অত্যন্ত কারুকার্য মণ্ডিত, দামি কড়ি ও অপূর্ব পাথরে মোড়ানো অগ্রভাগে দুইটি পরীর ভাস্কর্যসমৃদ্ধ বাড়িটি লতাপাতার অপরূপ নকশায় তৈরি করেন দিল্লী ও কলকাতার কারিগর ও রাজমিস্ত্রি। ইটসুরকির তৈরি বাড়িটি দেখে মনে হয় যেন শিল্পকর্ম। ৬০একর জায়গার উপর শত কক্ষবিশিষ্ট এ বাড়িটিকে ডাকা হয় পরীর দালান নামে।
একশত কক্ষ বিশিষ্ট বাড়িটি তিন একর জমির উপর নির্মিত। বাড়ির সামনে ও পিছনে দু’টি পুকুরসহ বাড়ির আঙ্গিনা ৩০ একর। চতুর্ভুজ আকারে বাড়ির প্রশস্ত দেয়াল বিশিষ্ট বাড়ির দু’পাশে রয়েছে সারি সারি ঘর। ইট, চুন, সুরকি দিয়ে নির্মিত দ্বিতল বিশিষ্ট বাড়ির সামনের অংশে কারুকার্য খচিত দর্শনীয় নকশা করা।
হল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত কড়িপাথর দিয়ে নকশা করা ছাদের উপর দু’পাশে রয়েছে দু’টি বিশ্রামরত পরীর মূর্তি। সামনে বিশাল ঘাট। পুরো আঙ্গিনা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এক সময় জমিদার প্রাসাদের পাশেই ছিল চিড়িয়াখানা ও নাট্যমঞ্চ। এখানে প্রায়ই কলকাতা থেকে শিল্পী ও জেনারেটর এনে আলোর ব্যবস্থা করে নাট্যমঞ্চে মঞ্চায়িত করতেন যাত্রা এবং নাটক।
১৯৪০ সালের দিকে জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক নেতা হাতেম আলী খানের নেতৃত্বে প্রজা বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়ে জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর বংশধররা ১৯৪৬ সালে দেশ বিভাগের পূর্বেই বহনযোগ্য জিনিসপত্র সাথে নিয়ে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ফেলে কলকাতায় চলে যান। যাওয়ার সময় নিয়ে যান সাত ঘোড়ার গাড়ি বোঝাই ধনদৌলত। জমিদারী গুটিয়ে নিলেও জমিদার বাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকে কালের সাক্ষী হয়ে। জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৯৫২ সালে ভারতের কাশিতে মৃত্যুবরণ করেন।
জমিদারের পরিত্যক্ত বাড়িটির আয়তন বড় দু’টি পুকুরসহ প্রায় ত্রিশ একর। ১৯৭৯ সালে এলাকাবাসীর উদ্যোগে জমিদারের পরিত্যক্ত বাড়িতে স্থাপন করা হয় হেমনগর ডিগ্রি কলেজ। বহু বছরের স্মৃতি বিজরীত এ প্রাসাদ যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এসব স্থাপত্য ইতিহাসের সাক্ষী ও ঐতিহ্য। এই ঐতিহাসিক নিদর্শনকে সংস্কার করে সংরক্ষণ করার দাবি এলাকাবাসীর।




আপনার মতামত লিখুন
Array