মশারী টানানোর খুনসুটি আর নাক ডাকার গপ্পো

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫
মশারী টানানোর খুনসুটি আর নাক ডাকার গপ্পো

জয়নাল আবেদীন: আমার জীবনে সবচেয়ে বিরক্তিকর কর্ম ছিল রাতে শোবার আগে বিছানার খাটে মশারী টানানো। কিন্তু বড়ই বিপদে পড়লাম বিয়ের পর। বাসর রাতেই গিন্নী শত কথার মধ্যে দুটো জিনিস নিশ্চিত হতে চাইলেন। এক- আমি রাতে নাক ডাকি কিনা? দুই- রাতে শোবার আগে মশারী টানানোর কাজ ভাগাভাগি করে নিবো কিনা? নতুন বউকে যেমন নাক ডাকার কথা বলা পাপ, তেমনি মশারী টানাবোনা, এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন বাক্য প্রয়োগও বুদ্ধিমানের কাজ ছিলনা। তাই মিচকে শয়তানের মতো চোখ টিপে সম্মতির ভাব দেখিয়ে রাতটা মজা করেই কাটালাম। এরপর বেশ কিছু দিন অতিকষ্টে, অশেষ ধৈর্য আর সংযম প্রদর্শন করে, মশারী টানিয়ে চললাম। কিন্তু নাক ডাকা বন্ধ
করা সম্ভব হলোনা। এমতাবস্থায় নাকের উন্নতির জন্য গ্রামের বাজারের এক মহান কবিরাজের স্মরনাপন্ন হলাম।

তিনি আমাকে গলায় পবিত্র তাবিজ লাগানোর পরামর্শ দিলেন। সাথে ভেন্নার তেল প্রয়োগের সাজেষ্ট করলেন। উনার দোকান থেকে তামার তাবিজ এবং এক বোতল ভেন্নার তেল কিনে আনলাম। শোবার আগে কালো সূতায় তাবিজটা
গলায় ঝুলালাম। তারপর দুই ফোটা ভেন্নার তেল নাসারন্ধে প্রবেশ করিয়ে বিছানায় যাওয়া শুরু করলাম। ভেন্নার তেলের তেমন ঝাঁজ না থাকলেও হালকা ঠান্ডা লাগতো। আলতোভাবে বার কয়েক তৈলাক্ত নাক ঢলে ঘুমিয়ে যেতাম। এভাবে মাস
খানেক চললো। কিন্তু এরপর তাবিজ আর ভেন্নার তেলের চিকিৎসা ব্যর্থ হলো। নাক ডাকা আবার ফিরে এলো। গিন্নী নাকডাকার কারণে বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকলো। এমতাবস্থায় নাকডাকার সমস্যা নিয়ে গোপালপুর পৌর শহরের হোমিও ডাক্তার ইয়াকুব আলীর পরামর্শ নিলাম। তিনি আমাকে শামুকের ডিমের মতো সাদা গুটির ওষুধ দিলেন। সেটি কয়েক মাস সেবন করলাম। প্রথম দিকে হালকা উপকার হলেও মাস ছয়েক পর হোমিও ওষুধ আর কাজে লাগেনি। যাই হোক, এর মধ্যে গিন্নী পোয়াতি হলো। আর নাক ডাকা বেড়ে গেলো। রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বেচারির কষ্ট দেখে নাক ডাকার সমস্যা নিয়ে পাশের গ্রামের মসজিদের এক ইমাম হুজুরের দ্বারস্থ হলাম।

তিনি দোয়া ইউনুস পড়ে আমার চোখ-মুখে ফুঁ দিলেন। তার ফুঁ নাকমুখে লাগলো। হুজুর খুব পানপাতা খেতেন। ফুঁ দেয়ার সময় পানপাতার সাথে বাশি মুখের গন্ধ নাকে গিয়ে বিধলো। পবিত্র দোয়া ভেবে এ দুর্গন্ধ বেহেস্তী মেওয়ার
মতো করে গ্রহন করলাম। তারপর হুজুর ২০০/ টাকা হাদিয়া নিয়ে দুটি তামার বড় তাবিজ গলায় পড়িয়ে দিলেন। একটি দোয়াও তিনি শিখিয়ে দিলেন। তবে তিনি তিনটি শর্ত দিলেন। প্রথম শর্ত- প্রতি মঙ্গলবার ও শুক্রবার রাতে ঘুমানোর আগে পবিত্র দোয়া খাস দিলে তিনবার পড়ে, বুকে ফুঁ দিয়ে, বামকাত হয়ে নিদ্রায় যেতে হবে। দ্বিতীয়ত- এ রহস্যের কথা বেডপার্টনারের কাছেও বলঅ যাবেনা। তৃতীয়ত- সেই রাতে যেন স্ত্রী সহবতে গমন না করি। প্রথম দিন গলায় আরো দুটো নতুন তাবিজ দেখে গিন্নী বিস্মিত হলেন। তিনি নতুন তাবিজের মাজেজা জানতে চাইলেন। তিনাকে বুঝিয়ে বললাম, ঘুমের ঘোরে খুবই দুঃস্বপ্ন দেখি। সেটির নিরসন কামনায় কামেল হুজুরের পরামর্শে নতুন তাবিজ নিয়েছি।
রাতে দুঃস্বপ্নের কথা শুনে গিন্নী কিছুটা ভড়কে গেলেন। নাক ডাকার সাথে দুঃস্বপ্ন, বাড়তি চিন্তার ভাঁজ কপালে পড়লো। সাত্বনা দেয়ার জন্য তিনি ডান কাত ঘুরে আমাকে বুকে আগলে রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাবিজ শর্তের কথা
ভেবে আমি বাম কাত হওয়া থেকে বিরত রইলাম।

গিন্নী হয়তো আমার ডান কাত, আর বাম কাতের রহস্য তখনো বুঝতে পারেননি। তাই কিছুটা অভিমান আর কিছুটা দুশ্চিন্তা নিয়ে বাম কাত হয়ে নিদ্রামগ্ন হলেন। সকাল বেলা আমাকে কিছু না বলেই বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরে গমন করলেন। গলায় নতুন তাবিজ পড়ার খবর আমাদের দুইজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলোনা। গিন্নীর মুখ থেকে সেটি আমার মা জননীর কানে গেলো। আমি ছিলাম মায়ের একমাত্র পুত্র। ৬ বোনের পর আমার ধরিত্রীতে আগমন। বালামুছিবত যেন ধারেকাছে না আসতে পারে সেই জন্য, বাল্যে আমার ডান কানের লতিতে স্বর্ণের রিং পড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কৈশোরে স্কুল মাঠে হাডুডু খেলতে গিয়ে লতি ছিড়ে রিং হারিয়ে যায়। আঘাত থেকে রক্তপাতে কানে ঘা হয়ে যায়। এরপর আর কানে রিং পড়া হয়নি। মা জননী প্রথমে ভাবলেন কানের লতির রিং ছিড়েই হয়তো অমঙ্গল হয়েছে। আমাকে কানের লতিতে পুনরায় রিং পড়ার প্রস্তাব দিলে রাজী হলামনা। এমতাবস্থায় মা জননী আমাকে নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। হুজুরের পানিপড়া সেবন আর গলায় ডাবল তাবিজ দেখে মা হয়তো ভেবেই বসেছিলেন যে, আমাকে নির্ঘাত জ্বীনে ধরেছে।

এমতাবস্থায় তিনি গ্রামের আরেক কবিরাজ সফিউদ্দীন সহুর নিকট থেকে জ্বীন ছাড়ানোর দুটি তাবিজ এনে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। এভাবে পাঁচটি তাবিজ গলায় ঝুলতে থাকলো। কিন্তু আমার নাকডাকা বন্ধ হলোনা। মনটা ক্রমেই খারাপ
হতে লাগলো। হতাশ হয়ে ভাবলাম এ জীবনে হয়তো কোনদিনই আর নাক ডাকা বন্ধ হবেনা।

এমনি দুশ্চিন্তায় দিনের পর রাত কাটতে থাকে। কোন এক শীতের রাতে দু’চোখে একদম ঘুম ছিলনা। গভীর রাতে হঠাৎ কাছ থেকে নাক ডাকার শব্দ পেলাম। ঘোরের মধ্যে পড়ে, নিজের নাক চেপে ধরে, বোঝার চেষ্টা করলাম, আমি
ঘুমিয়ে গেছি কিনা অথবা নাক ডাকার শব্দটা আমার নাক থেকেই বেরুচ্ছে কিনা! ক্ষনিক পর নিশ্চিত হলাম ডাকটা আমার নাকের নয়। এমতাবস্থায় গায়ে চাপিয়ে দেয়া লেপটা একটু সরালাম, আর বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম আমার বেডপার্টনার আরামছে ঘুমাচ্ছে, আর অনবরত নাক ডাকছে। গিন্নীর নাকডাকা দেখে আমি হেসে ফেললাম। ভাবলাম আমার নাকডাকা সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। গা থেকে লেপটা টেনে নেয়ায় ঠান্ডার পরশে গিন্নীর ঘুম ভাঙ্গলো।

আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, কি ব্যাপার এখনো ঘুমাওনি? আমি উত্তর না দিয়ে, গলার তাবিজগুলো, টেনেহিচড়ে ছুঁড়ে ফেললাম। গিন্নী বিস্মিত হয়ে বললো- আরে করো কি, করো কি, ওসব তাবিজকবাজ কেন খুলে ফেলছো। তোমার নাক ডাকা তো বেড়ে যাবে। বললাম- নাকডাকার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। তাই ওসব ছুঁড়ে ফেলছি। গিন্নী বললো- কিভাবে সমাধান হলো? বললাম- ওই যে, তুমিও এখন আমার নাক ডাকার পার্টনার হয়ে গেছো। এ নাকডাকাটাই এখন
আমার ভরসা। তিনি হাসি মুখে বললেন- তোমার দ্বারা আমি
আক্রান্ত হয়েছি। একসঙ্গে দীর্ঘদিন মিলেমিশে, আদর-
সোহাগে বসবাসের ফলে জীবনের সব ভালোমন্দ, দোষগুণ
যেমন ভাগাভাগি করেছি, তেমনি ভাগাভাগিতে নাক
ডাকার ওয়ারিশটাও পেয়ে গেছি। এটার নামই দাম্পত্য
জীবন। জনান্তিকে বলছি, দুজনের সংসার বাধার ৪৫ বছর
চলছে। দুজনই সত্তুর অতিক্রম করছি। এখনো ঘুমোতে
গিয়ে দু’জনেই নাক ডাকাডাকি করি। রাতের নাক
ডাকাডাকিতে এখন কারো কোন বিরক্তবোধ নেই। নাক
ডাকা আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ন পার্ট।
এটিকে জয় করেই জীবন সামনে এগিয়ে চলছে।
শুরু করেছিলাম রাতে মশারী টানানোর কথা দিয়ে। আমি
পারতপক্ষে এখনো মশারী টানানোতে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা

করি। মশারী টানানোর পালার রাতে আমি আগেভাগে
বিছানায় গা এলিয়ে দুচোখ বন্ধ করে নাক ডাকার ভান
করি। গিন্নী তখন মুচকি হেসে বলেন, উহু হলোনা স্যার।
ঘুমের ঘোরে নাকডাকা আর মশারী টানানোয় ফাঁকি
দেয়ার মেকি নাকডাকার বিস্তর ফারাক। নকল নাকডাকা বন্ধ
করুন। আর দয়া করে মশারীটা টানান।

লেখকঃ অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও সংবাদকর্মী

সংবাদটি স্বদেশ প্রতিদিনওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এই সংবাদে কোনো প্রকার বিকৃতি, ভুল তথ্য সংযোজন বা বিভ্রান্তিকর পরিবর্তন করিনি। তথ্যের সঠিকতা ও মালিকানা বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে অনুগ্রহ করে মূল সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।