টা ঙ্গা ই ল ৩
ঘাটাইলে বিএনপিতে প্রার্থীর ছড়াছড়ি, অন্যান্য দলে একক
ঘাটাইলে বিএনপিতে প্রার্থীর ছড়াছড়ি, অন্যান্য দলে একক
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় যতই ঘনিয়ে আসছে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনেও বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। গ্রামগঞ্জে, হাট-বাজারে, চায়ের দোকানে প্রার্থীদের নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ, আলাপ-আলোচনা। শহরের অলি-গলিতে সবখানেই রং-বেরংয়ের ব্যানার-ফেস্টুন, দেয়াল লিখন, লিফলেট আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের দৃশ্য এখন চোখে পড়ছে। টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণসংহতি আন্দোলন, এনসিপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছে। এখানে বিএনপি’র ৭ জনসহ অন্যান্য দলে মোট ১২ জন প্রার্থীর নাম জানা গেছে।
মূলত ঘাটাইল আসনটি বিএনপি’র দুর্গ হিসেবে পরিচিত। অন্যান্য দলের প্রার্থী থাকলেও বিএনপি’র প্রার্থীরাই এই আসনে বিএনপি’র মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। এখানে বিএনপি’র প্রার্থীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মতো করে উঠান বৈঠক, সভা সমাবেশ তারেক রহমানের রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা বাস্তবায়নের লিফলেট বিতরণ, বিভিন্ন স্কুল কলেজে গাছের চাড়া বিতরণ, প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার বিতরণ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনুদান প্রদানসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যোগদান করছেন নিয়মিত। বিগত ৩৭ বছরের ইতিহাসে লুৎফর রহমান খান আজাদ ছাড়া কাউকে এই আসন থেকে বিএনপি’র প্রার্থী হতে দেখা যায়নি। এ আসনে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র মনোনয়ন পেয়ে টানা চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান খান (আজাদ)। এমপি হয়ে ১৯৯১, ২০০১, ২০০৮ সালে তিন দফা বিএনপি’র মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিলেন তিনি। মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মন্দির, হাসপাতাল, দৃষ্টিনন্দন পৌরসভা, ব্রিজ কালভার্ট তৈরির পাশাপাশি দিনের বেলায় পাহাড়ি জনপদ দিয়ে মানুষ যেখানে হেঁটে যেতে ভয় পেতেন সেই দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের আনাচে-কানাচে পাকা রাস্তা নির্মাণ করে আধুনিক ঘাটাইলের রূপকার হিসেবে তিনি খেতাব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঘাটাইলে যত উন্নয়ন হয়েছে মূলত তার হাত ধরে হয়েছে। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপি’র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও একতরফা ও পাতানো নির্বাচন হাওয়ায় ভোট বর্জন করেন। জয়-পরাজয় যা-ই হোক, অতীতে কখনোই এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে তাকে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু এবার তিনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। টানা ৩৬ বছর টাঙ্গাইল-৩ ঘাটাইল আসনটি আজাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য এডভোকেট ওবায়দুল হক নাসির এসে তাকে রীতিমতো বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন। এ ছাড়াও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তাকে নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন অভিভাবকশূন্য ছিল ঘাটাইল উপজেলা বিএনপি। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আমলে ১৬ বছর হাতেগোনা ২-৪ জন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত দলীয় কোনো নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখেননি লুৎফর রহমান খান আজাদ। আওয়ামী লীগের রোষানলে পড়ে শত শত নেতাকর্মী মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়ে মানুষের রান্নাঘর কাচারি ঘর, বাঁশঝাড় ও ধান ক্ষেতে পালিয়ে বেড়ালেও ন্যূনতম সহযোগিতা ও যোগাযোগ ছিল না তার সঙ্গে। হাজার হাজার নেতাকর্মী হামলা-মামলা ও নির্যাতনে শিকার হলেও তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। অনেক চেয়ারম্যান দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচিত হয়ে তার ভুলের কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি তাদের ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। ফলে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে ঘাটাইল উপজেলা বিএনপি। এ ছাড়াও নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যার ফলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা রাগে, দুঃখে ও ক্ষোভে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। দিগি¦দিক ছুটে চলা তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যখন মামলা-হামলা ও নানা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে ঠিক তখনি ঝিমিয়ে পড়া বিএনপিকে উজ্জীবিত করতে কেন্দ্রীয় বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এস এম ওবায়দুল হক নাসির আসে ঘাটাইল উপজেলা বিএনপি’র হাল ধরতে। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বিভিন্ন ইউনিটের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে বেড়ে ওঠা এই নেতা দল গোছাতে এসে এখন তিনি ঘাটাইল থেকে দলীয় মনোনয়ন চাইছেন। দীর্ঘদিন ধরে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই এমন সব নেতাদের দিয়ে কমিটি গঠন করে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত ঘাটাইল উপজেলা বিএনপিকে দ্বিখণ্ডিত করে নিজের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছেন।
এ ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় তার পছন্দের অযোগ্য লোকদের সভাপতি সম্পাদক পদে নিয়োগ দিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। তার দেয়া কমিটির নেতাকর্মীরা পাহাড়ের লাল মাটি বিক্রি বনজ সম্পদ ধ্বংস বিচার সালিশের নামে মানুষকে হয়রানি করার সুযোগ তৈরি করে দেয়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ফলে উপজেলা বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এক অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন লুৎফর রহমান খান আজাদ এবং অপর অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য এডভোকেট ওবায়দুল হক নাসির। দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্র ঘোষিত যেকোনো দলীয় কর্মসূচি আলাদা আলাদাভাবে পালন করে আসছেন তারা। আজাদ গ্রুপের নেতাকর্মীরা বলছেন, কেন্দ্রে নাসিরের ২-৪ জন নেতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও তৃণমূলে তার গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। আমাদের নেতা লুৎফর রহমান খান আজাদ গত ৩৭ বছর ধরে ঘাটালের মানুষের সেবা করে আসছেন। তিনি চারবার এমপি ও তিনবার মন্ত্রী থাকার পরেও নিজের জন্য কিছুই করেননি। তার তেমন কোনো বাড়ি-গাড়ি, ধন-সম্পদ নেই। তার বয়স বর্তমানে ৭০ এর ঊর্ধ্বে। এটাই তার জীবনের শেষ নির্বাচন। তার জীবনের মূল্যবান ৩৭টি বছর দলের জন্য ও ঘাটালের মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন। এবারো তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী। আমাদের বিশ্বাস দল তাকে সঠিক মূল্যায়ন করবে এবং ঘাটাইলের এমপি কে হবে সেটা নির্ধারণ করবে ঘাটাইলের মানুষ। অপরদিকে, নাসির গ্রুপের নেতাকর্মীরা বলছেন গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যার নামে একটি মামলা হয়নি, দুর্দিনে নেতাকর্মীদের খবর রাখেনি- সে ঘাটাইল থেকে পুনরায় এমপি হওয়ার খোয়াব দেখলেও তার সেই স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। আমাদের নেতা ওবায়দুল হক নাসির একদিনে তৈরি হয়নি। তার রাজনৈতিক মেধা, মননশীলতা, দলের প্রতি আস্থা, কঠোর পরিশ্রম, একের পর এক হামলায় রক্তাক্ত হওয়া, শতাধিক মামলায় জেল-জুলুম রিমান্ড এবং বিভিন্ন অত্যাচার সহ্য করে অল্প বয়সেই দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছেন তিনি। জিয়া পরিবারের দুর্দিনে তাদের পাশে থেকেছেন। কাজেই আমরা ঘাটাইলের মানুষ তাকেই এমপি হিসেবে দেখতে চাই। এ ছাড়াও বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য ও পূর্ব ঘাটাইলের পাহাড়ি লাল মাটির কৃতী সন্তান মাইনুল ইসলাম দলীয় মনোনয়ন চাইছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি যখন প্রতিটি উপজেলায় দু’জন করে প্রার্থী মনোনীত করে তখন মাইনুল ইসলামের নাম ছিল সেই তালিকায়। সম্পূর্ণ ক্লিন ইমেজের এই নেতার পাহাড়ি অঞ্চলে রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে দলের সকল নেতাকর্মীরা যখন হাত-পা গুটিয়ে বাসায় বসে থাকতেন, ভয়ে কেউ কথা বলার সাহস পেতেন না, মিছিল মিটিং করার সুযোগ ছিল না, সেসময় মাইনুল ইসলামের ভূমিকা ছিল সকলের ঊর্ধ্বে। তার দাবি, দলের দুর্দিনে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন। দলীয় সকল নির্দেশনা নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে থেকে পালন করতেন। বর্তমানে ঘাটালের রাজনীতি এতটাই হিংসাত্মক যে, এক গ্রুপের নেতাকর্মী অপর গ্রুপের নেতাকর্মীকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে ঘাটাইল উপজেলা বিএনপিতে কোনো দ্বিধা বিভক্তি থাকবে না। যেহেতু ঘাটাইল আসনটি বিএনপি’র একটি উর্বর ভূমি, সেহেতু আমাকে মনোনয়ন দিলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমানের হাতকে শক্তিশালী করার সুযোগ তৈরি হবে।
অপরদিকে, ফ্যাসিস্ট হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের রাজপথের লড়াকু সৈনিক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদলের সদস্য সচিব, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেউলাবাড়ির কৃতী সন্তান মো. খলিলুর রহমান খলিলও নির্বাচনের লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন এই আসন থেকে। আলোচনায় রয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি, মো. জাহিদুর রহমান দিপু সরকার।
এ ছাড়াও ঘাটাইল আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী শিল্পপতি ও কেমি প্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তরুণ ছাত্রনেতা মো. শামীম মিয়া। যিনি বিগত করোনাকালীন সময়ে নিজের টাকা খরচ করে হাজার হাজার নেতাকর্মীর ঘরে খাবার, ওষুধ ও বিভিন্ন সরঞ্জাম পৌঁছে দিয়েছেন এবং অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে থেকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। আলোচনায় রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক ও ক্রিয়া সম্পাদকসহ বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত তরুণ ছাত্রনেতা ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল কেন্দ্রীয় সংসদের যুগ্ম সম্পাদক মিয়া রাসেল। জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হুসনে মোবারক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রেজাউল করিম, গণসংহতি আন্দোলনের মোফাখারুল ইসলাম, এনসিপি’র উত্তরাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক সাইফুল্লাহ হায়দার প্রার্থী হবেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩,৫৯,৩৮০ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১,৮০,৪৯৩ জন, এবং মহিলা ভোটার ১,৭৮,৮৮৫ জন, হিজড়া ভোটার ২ জন।




আপনার মতামত লিখুন
Array